আওয়ামী লীগের জায়গা নেই, এক ঘরে জাতীয় পার্টি

আওয়ামী লীগের জায়গা নেই, এক ঘরে জাতীয় পার্টি

বিশেষ প্রতিনিধি: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আর রাজপথে দাড়াতে পারেনি ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ। এমনকি মহাজোটের শরিক দল ও পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সহযোগী জাতীয় পার্টি এখন এক ঘরে। জাতীয় পার্টি তো গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করেনি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তারা মনে করেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও সিনিয়র-জুনিয়র নেতাকর্মীরা চলে যান আত্মগোপনে। ফলে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব এখন নেই বললেই চলে। আর আওয়ামী লীগের সহযোগি জাতীয় পার্টিও দুই একজন নেতাকর্মী প্রকাশ্যে থাকলেও বেশির ভাগই আত্মগোপনে রয়েছে। গত ৫ আগস্টের দলটির মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের আত্মগোপন এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ভয়ে বের হচ্ছেন না। মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের কেউ কেউ জেলে আছেন। তাছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে কিছু মব জাস্টিস হয়েছে। যার কারণে দলটির নেতাকর্মীরা ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। কেউ কেউ দেশের বাইরে চলে গেছেন। তাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা বা কর্মসূচি দেওয়ার কেউ নেই। যদিও আত্মগোপনে থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তাতে কোনো সারা মেলেনি। তবে আজকে আওয়ামী লীগের এই পরিণতির জন্য তারাই দায়ি। গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে প্রায় ১৪’র বেশি নিহত হন। আহত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি। তাদের মধ্যে অনেকেই হাত, পা ও চোখ হারিয়েছেন। কেউ কেউ পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন। এখনও অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু দলটি দুঃখ প্রকাশ করেনি। এমনকি তাদের মধ্যে কোনো অনুতাপও নেই। তারা ভিন্নমত দমনে শহনশীলতা তো দেখায়নি বরং এমন কোনো নির্যাতন নেই যা করেনি। তাদের উচিত ছিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখা, যেটি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার ক্ষেত্রে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এই সরকার ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ আবারও সুযোগ নেবে। আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে মাঠ গোছানোর চেষ্টা করবে। তবে খুব শিগগরি আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে জায়গা করতে পারবে না বলেও মনে করেন তারা।

তারা বলেন, নিজেদের কৃতকর্মের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা না চাইলে মাঠের রাজনীতিতে ফেরা আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটা কঠিন হবে। আর জাতীয় পার্টি তো আওয়ামী লীগের গৃহপালিত ছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার সাধ গ্রহণ করেছে। তাই জাতীয় পার্টির আজকের এই পরিণতি। তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও হামলা করা হয়েছে। তারা যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে লেজুরবৃত্তির রাজনীতি না করতো তাহলে জাতীয় পার্টির অবস্থান ভালো থাকতো। তারা এখন অনেকটা এক ঘরে। তাদের কোনো কর্মসূচি নেই। তারা মাঠেও বের হতে পারছে না।

এদিকে, জাতীয় পার্টি ঘরোয়াভাবে দুই একটি কর্মসূচি পালন করলেও আওয়ামী লীগের দেখা নেই দেশের রাজনীতি বা কোনো কর্মসূচিতে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। পরে গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদ। এরপর পরই সামনে চলে আসে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহদাত বার্ষিকী ও ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস। পরে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীব দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। কিন্তু এই বিশেষ বিশেষ দিনে কোনো দিবসই পালন করতে পারেনি ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ। গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বেরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হামলার শিকার হন। পরে ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও মাঠে দেখা যায়নি কোনো নেতাকর্মীর। বরং ওইদিন রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের গেটেই দেখা গেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের অবস্থান। ফলে নূর হোসেন দিবসে বিক্ষোভ কর্মসূচি ডাক দিয়েও মাঠে নামতে পারেনি আওয়ামী লীগ। কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সেখানে আসলেও তারা মারধরের শিকার হন। এমনকি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই সঙ্গে ওইদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা অবস্থান নেন জিরোপয়েন্টে। সেখান থেকে সংগঠনটির নেতারা আওয়ামী লীগের বিচার ও তাদের রাজনীতি বন্ধে সরকারের কাছে দাবিও জানায়। ওইদিন নূর হোসেন দিবসে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট চত্ত্বরে ফুল দিতে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদেরও কেউ কেউ এসময় গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের নিষিদ্ধের দাবিও জানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করার পরেই দলটির মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা আত্মগোপনে যান। এতে করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। ফলে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও ভয়ে বাড়ি ঘর ছেড়েছেন। কেউ কেউ দেশের বাইরে চলে গেছেন। তাদের এখন কর্মসূচি দেওয়ার মতো নেতারাও নেই। যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপনে থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করছে। কিন্তু যেহেতু দলটির নেতারা আত্মগোপনে, তাই কর্মসূচিতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা সারা দেয়নি। আওয়ামী লীগের এই পরিণতির জন্য তারাই দায়ি। গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে প্রায় ১৪’র বেশি নিহত হন। আহত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি। তাদের মধ্যে অনেকেই হাত, পা ও চোখ হারিয়েছেন। কেউ কেউ পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন। এখনও অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু দলটি দুঃখ প্রকাশ করেনি। এখন এমন পরিস্থিতি দাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে মাঠ গোছানোর সুযোগটুকু পাচ্ছে না। দলটি জনগণের কাছে ক্ষমা না চাইলে মাঠের রাজনীতিতে ফেরা কঠিন হবে। আর জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের গৃহপালিত ছিল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার সাধ গ্রহণ করেছে। তাই জাতীয় পার্টির আজকের এই পরিণতি। তারা যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে লেজুরবৃত্তির রাজনীতি না করতো তাহলে জাতীয় পার্টির অবস্থান ভালো থাকতো। তারা এখন অনেকটা এক ঘরে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। দলটির নেতাকর্মীরাও আজকে পলাতক। কেউ কেউ রয়েছেন জেলে। তবে তাদের এই পরিণতির জন্য আওয়ামী লীগই দায়ি। এই দায় কেউ নেবে না। তাদের ভিন্নমত দমনে আরেকটু শহনশীল হওয়া দরকার ছিল। তারা ভিন্নমত দমনে এমন কোনো নির্যাতন নেই যা করেনি। তাদের উচিত ছিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখা, যেটি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা বাইরে থেকে নানাভাবে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো নেতাকর্মী প্রকাশ্যে আসছেন না। তবে খুব শিগগরি যে তারা রাজনীতিতে জায়গা করতে পারবে বলেও মনে হচ্ছে না। আর জাতীয় পার্টি তো গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করেনি। তারা ক্ষমতার সাধ নিতে আওয়ামী লীগের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে সায় দিয়ে গেছে। এরই কারণে জাতীয় পার্টি আজকে এক ঘরে অবস্থায় রয়েছে। তারা মাঠের কোনো কর্মসূচি দিতে পারছে না। এমনকি প্রকাশ্যেও রাজনীতি করতে পারছে না। কারণ তারা যেহেতু আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। সে কারণেও তারাও আজকে ভীত।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, এখন তো আওয়ামী লীগ নিধনের রাজনীতি চলছে। কথা বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিহিংসার রাজনীতির এই বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে নেতাকর্মীদের বাধা, হামলা ও গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিজয় দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দিতে হবে। কিন্তু সেটা করছে না সরকার।

যদিও মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বিজয় দিবসের এক আলোচনা সভায় দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে তার দল। তবে তার আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত, ভুয়া মামলা প্রত্যাহার, সভা-সমাবেশের অধিকারসহ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার চায় জাতীয় পার্টি। হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে। শাস্তি দেওয়ার নামে দেশে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে গণঅভ্যুত্থানের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। যেভাবে হানাহানি ঘটছে তাতে আগামীতে দেশ আবারও অন্ধকারে যেতে পারে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে তার অত্যাচারের কারণে। এমন লজ্জাজনক পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারপ্রধানের হয়নি। রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ফিরবে, অবশ্যই ফিরবে, তবে, সেটি হচ্ছে বিচারের জন্য, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার জন্য। গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজনীতি করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ গণহত্যার সাথে যারা জড়িত, যতদিন তাদের বিচার নিশ্চিত না হবে ততদিন দলটির জনসম্মুখে আসার কোনো অধিকার নেই।

 

এস/এ