জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা
দেশ সংস্কারের ছয় কমিশন
বিশেষ প্রতিনিধি: অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা দেশের সংস্কার চাই। সংস্কারের মাধ্যমে জাতি হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চাই। আর সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ চৌধুরী, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন। এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শ সভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
বুধবার সন্ধ্যায় অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর এই কমিশন আগামী পয়লা অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করছি। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শসভার আয়োজন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেওয়া হবে। আমরা যেহেতু জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাস করি, সেহেতু নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে আমাদের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে। নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব আশঙ্কা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা ভাবছি। নির্বাচনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানা ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে।
ড. ইউনূস বলেন, তৈরি পোষাক, ঔষধ শিল্প এসব এলাকায় শ্রমিক ভাইবোনেরা তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য ক্রমাগতভাবে শিল্পের কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধ রাখতে বাধ্য করছেন। এটা অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটা মোটেই কাম্য নয়। এমনিতেই ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপ্লবের পর যে অর্থনীতি পেয়েছি, সেটা নিয়ম নীতিবিহীন দ্রুত ক্ষীয়মাণ একটা অর্থনীতি। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। আমরা এই অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করছি। ঠিক এই সময়ে আমাদের শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে, অকার্যকর হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট আঘাত পড়বে। সেটা কিছুতেই কারো কাম্য হতে পারে না। শ্রমিক ভাইবোনদের অনেক দু:খ আছে। কিন্তু সেই দু:খ প্রকাশ করতে গিয়ে মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান অবশ্যই বের করবো। অর্থনীতির চাকা সচল রাখুন। অর্থনীতির দুর্বল স্বাস্থ্যকে সবল করে তুলুন। ঔষধ শিল্প এবং তৈরি পোষাক শিল্প দেশের গৗরব। এর সাফল্য এখন থমকে আছে। আমরা এই দুই শিল্পকে তাদের সম্ভাব্য শীর্ষে নিয়ে যেতে চাই। দুর্বল করারতো প্রশ্ন উঠেই না। বিদেশি ক্রেতাদের একত্রিত করে তাদের সহযোগিতা চাইবো যেন বাংলাদেশের এই শিল্প দুটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি আস্থাযোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় মাস থেকে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি হিসেবে নতুন শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের সূচনা করতে চাই।
ড. ইউনূস বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বিচার বিভাগের বড় সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। যোগ্যতম ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়াতে মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ সহ অনেকগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ এবং অন্যান্য নিয়োগ সবকটাই সম্পন্ন হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন ও ডিজিটাল/সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ দেশে বিদ্যমান সব কালো আইনের তালিকা করা হয়েছে। অতি সত্বর এ সব কালো আইন বাতিল ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করা হবে। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ বহুল আলোচিত ৫টি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা বলপূর্বক গুম থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সনদে স্বাক্ষর করেছি। ফলে স্বৈরাচার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত “গুম সংস্কৃতি’র সমাপ্তি ঘটানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। এছাড়া আমরা ফ্যাসিবাদী শাসনের ১৫ বছরে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য পৃথক একটি কমিশন গঠন করছি। আয়নাঘরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বের হয়ে আসছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের গুমের শিকার ভাইবোনদের কষ্ট ও যন্ত্রণা গাথা। গণঅভ্যুথানে সব শহিদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। সব আহত শিক্ষার্থী ও জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। শহিদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার “জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন” নামে একটি ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে। শহিদ পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসাসহ তাদের পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ফাউন্ডেশন নিয়েছে।
তিনি বলেন, গত মাসে কুমিল্লা-নোয়াখালী সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা হয়েছে। এ এলাকার মানুষ বন্যা মোকাবিলা করায় অভ্যস্ত নন। সশস্ত্রবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে বন্যা আক্রান্ত সবাইকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে। সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনী পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে একযোগে কাজে নেমে পড়ার ফলে মানুষের দুর্ভোগ কম হয়েছে। এর পরপরই এনজিও এবং সাধারণ মানুষ দেশের সকল অঞ্চল থেকে দলে দলে এগিয়ে এসেছে। আমি সেনাবাহিনীকে আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়সহ সয প্রাকৃতিক দুর্যোগে সশস্ত্রবাহিনী শেষ ভরসার স্থান। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের কঠিন কাজ সামনে রয়ে গেছে। সবার সহযেগিতায় পুনর্বাসনের কাজটি সফলভাবে সমাধান করতে চাই।
ড. ইউনূস বলেন, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। যেসমস্ত ভাই-বোনেরা তাদের গত ১৬ বছরের বেদনা জানিয়ে তার প্রতিকার পাওয়ার জন্য আমার অফিস এবং সচিবালয়ের অফিস সমূহের সামনে প্রতিদিন ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে আমাদের কাজকর্ম ব্যাহত করছিলেন, তারা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘেরাও কর্মসূচি থেকে বিরত হয়েছেন বটে, তবে অন্যত্র আবার তারা তাদের কর্মসূচি দিয়ে যাতায়াতে ব্যাঘাত ও সৃষ্টি করেছেন। কথা দিচ্ছি আপনাদের ন্যায্য আবেদনের কথা ভুলে যাবো না। আমরা সব অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অনুরোধ করছি যাতায়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি থেকে বিরত থাকুন।
তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতে যেন উজ্জ্বল হয় সেটা নিশ্চিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে পূর্ণ নজর রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। বই সংশোধন এবং পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। এ সংস্কারের কাজ অব্যাহত থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের উচ্চ প্রশাসনিক পদগুলো পূরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ডে দখলদারিত্বের রাজনীতি বন্ধ করার ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। আমাদের প্রথম মাসে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যরা পদত্যাগ করেছেন। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। প্রথম মাসে আমরা ক্রমাগতভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেয়ার কাজ শুরু করেছি।
সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সরকার প্রধান বলেন, সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধা বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন। আরো যেসব কমিশন সরকারসহ অন্য সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে, আমরা তাদের পুনর্গঠন ও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি যাতে তারা আরো শক্তিশালী হয়, জনকল্যাণে কাজ করে।
তিনি বলেন, আমরা স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের অহেতুক কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেখেছি যেগুলো কখনোই দেশের মানুষের জন্যে ছিল না। চলমান এবং প্রস্তাবিত সব উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর যাচাই বাছাই করার কাজ শুরু করেছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায় বিবেচনা করে বাকি কাজে ব্যয়ের সাশ্রয় এমনকি প্রয়োজনবোধে তা বাতিল করার কথা বিবেচনা করা হবে। দেশের মানুষকে আর ফাঁকি দেওয়া চলবে না। কর্মসংস্থান তৈরি করবে এমন প্রকল্পগুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দেবো। লুটপাট ও পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটা ব্যাংকিং কমিশনও গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার লুটপাট করার জন্য নতুন করে ষাট হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজার ছাড়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে দেশের মানুষ। এই অতুলনীয় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অন্তর্র্বতী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পলিসি সুদের হার বৃদ্ধি করে ৯ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিসহ সুলভ মূল্যে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ চলমান রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরে চাল ও গম আমদানির জন্য ৫,৮০০ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের জন্য ৮,৯০০ কোটি টাকা এবং খাদ্য ভর্তুকির তিনটি প্রোগ্রামের জন্য ৭,৩৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার অনৈতিক অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সাপোর্ট চাওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিশ্ব ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জাইকা থেকে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের অনুরোধ করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রিমের অর্থ পরিশোধ এবং বকেয়া পাওনা নিয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলোচনা চলছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অর্থ বিভাগের রাজস্ব আয় সম্পর্কিত উপাত্তের মধ্যে পার্থক্য নিরসনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকৃত রপ্তানি আয় নিরূপণ এবং প্রকাশের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমাইজেশনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। পুঁজি বাজারকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার নিমিত্ত ব্যবসায়ী, শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সাথে সভা করা হয়েছে। বিদ্যমান মজুদ ও ঘাটতি মূল্যায়ন করে ও ভবিষ্যৎ চাহিদা পর্যালোচনা করে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি পর্যায়ে বিভিন্ন জটিলতা দূরীকরণ, বন্দর ও বড় মোকামসহ পরিবহণ ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বিভাগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় হতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের অধীন চলমান সব প্রকার নেগোসিয়েশন, প্রকল্প বাছাই এবং ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। গত দেড় দশকে এই আইন ব্যবহার করে লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কোম্পানিসমূহে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনার লক্ষ্যে কোম্পানিসমূহের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বয়স সাড়ে বারো বছরের কম ছিল, তাদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকা হতে বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিলের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের আওতাধীন বেদখলকৃত স্থাবর সম্পত্তি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক পৃহিত বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন এর খসড়া তৈরির কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প ও ঢাকার আশেপাশে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের রোডম্যাপ চূড়ান্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিধি বহির্ভূত প্রদত্ত প্লট ও ফ্ল্যাটের বরাদ্দ বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল গণভবন। এটা ছিল স্বৈরাচারের কেন্দ্রবিন্দু। এই সরকার বিপ্লবের প্রতি সম্মান দেখিয়ে গণভবনকে বিপ্লবের জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ছাত্র-জনতার ক্ষোভকে স্থায়ীভাবে তুলে ধরার জন্য গণভবনের আর কোনো সংস্কার করা হবে না। ছাত্র-জনতার ক্ষোভের মুখে তা যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল সে অবস্থায় তাকে রাখা হবে। যেসব মূল্যবান সামগ্রী জনতা নিয়ে গিয়েছিল সেগুলো অনেকে ফেরত দিয়ে গেছে। যারা নিয়ে গিয়েছিল তারা নিজেরাই ফেরত দিয়ে গেছে। আরো কিছু জিনিস পাওয়া যায়নি। যার নিয়ে গিয়েছেন তাদের কাছে অনুরোধ তারা যেন এসব সামগ্রী ফেরত দিয়ে যান।
এস/এ