জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার: বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং করণীয়
মো. আশরাফ উদ্দিন
জীববৈচিত্রের সন্নিবেশ এবং সমাহারে সৃষ্ট প্রকৃতি এবং প্রতিবেশ-এর উপর ভিত্তি করে টিকে আছে আমাদের জীবন। সৃষ্টির সেরা জীব হলেও বিশ্বজুড়ে প্রতিবেশ বিনষ্ট এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদের বিলুপ্তির মূলে রয়েছে মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড। বিশ্বব্যাপী মানবসৃষ্ট চাপে অবক্ষয়ের মুখে পতিত প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের সংকল্প বাস্তবায়নে যাতে মানুষের মনন, মনীষায় একটি প্রজন্মগত পরিবর্তন আসে এবং বর্তমান প্রজন্ম যেন প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসে সে লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীর এমন এক সংকটময় মূহুর্তে পালিত হচ্ছে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস, ৫ জুন।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত মান উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন সচেতনতা সৃষ্টি এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংরক্ষণ কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এর উদ্যোগে ১৯৭২ সাল থেকে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি এ বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য- ÔEcosystem RestorationÕ‘ (প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার) এবং শ্লোগান ÔJoin # Generation RestorationÕ (প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি) নির্ধারণ করেছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্যে মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য মানবসমাজ যেন উদ্বুদ্ধ হয় সে প্রচেষ্টা ব্যক্ত হয়েছে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ২০২০ এবং ২০২১ পরপর ২ বছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্যে জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতি সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেছে। উল্লেখ্য, বিগত ২০২০ সালের বিশ্ব দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো ‘জীববৈচিত্র্য’ (Biodiversit) এবং স্লোগান ÔTime for NatureÕ (প্রকৃতিকে বাঁচানোর এখনই সময়)। এছাড়াও, জাতিসংঘ ২০১১-২০২০ এ দশককে UN Decade on Biodiversity হিসেবে উদযাপন করেছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ২০২১ থেকে ২০৩০ এ দশককে UN Decade Ecosystem Restoration হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ ছাড়াও বর্তমান জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ পরিবেশ ঘোষিত বিগত বছর এবং এ বছরের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য এবং স্লোগান অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি সংরক্ষণে আমরা কী করবো, কী করবো না সে বিষয়ে এ প্রজন্মের প্রত্যেক নাগরিককে দায়িত্ব নিতে হবে, দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, সে অমোঘ বাণীটিই নিয়ে এসেছে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীন। জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রকৃতি ধ্বংসের বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লক্ষ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে হচ্ছে তা যদি চলতে থাকে তাহলে ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তিনটির মধ্যে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। গত ৫০ বছরে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। সে হিসেবে গত ১০ মিলিয়ন বছরের তুলনায় বর্তমানে প্রজাতি বিলুপ্তির গড় হার ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। পৃথিবীব্যাপী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভগুলো মনুষ্য কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূ-ভাগে মানুষ ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করেছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রতিবেশ আজ পরিবেশগত হুমকীর সম্মুখীন। ২০১০ হতে ২০১৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। আমরা যদি পরিবেশগত এ অবক্ষয় রোধ করতে না পারি তাহলে ব্যাপকভাবে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই কাজ শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার Water Pollution Control Ordinace ১৯৭৩ জারি করে। ১৯৭৩ সালেই তিনি পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকৃতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের সূচনা করেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার জন্য একই বৎসরে জারি করা হয় Bangladesh Wild Life (Preservation) Order ১৯৭৩. পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারির ধারাবাহিকতায় পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয় এবং ২৬ জনবল বিশিষ্ট পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ সেল গঠিত হয়। ১৯৮৫ সালে এসে ৭০ জনবল বিশিষ্ট পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গঠন করা হয়। ১৯৭৭ সালে পরিবেশ দূষণ অধ্যাদেশ জারি করার পর পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ সেলের কার্যক্রম মনিটর করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্যের নেতৃত্বে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গঠন করা হয়। সরকার ১৯৮৯ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় নামে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করে এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নাম পরিবর্তন করে পরিবেশ অধিদপ্তর করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিবেশ অধিদপ্তর তার সীমিত জনবল ও বাজেট দিয়ে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচেছ। বিপুল জনগোষ্ঠী, দারিদ্র, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দেশের জীববৈচিত্র্য তথা সার্বিক পরিবেশগত সমস্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশ সংরক্ষণে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে-“রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।” তাই, জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণ এখন আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর এ বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে নির্মোহভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল বৃদ্ধি করে ১০৮৭ জনে উন্নীত করেছে এবং দেশের সবকটি জেলায় (৬৪ টি জেলা) অফিস চালু করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
সরকার ১৯৯২ সালে প্রথম পরিবেশ নীতি, ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা এবং ২০১০ সালে পরিবেশ আদালত আইন বলবৎ করে। জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে লাল শ্রেণিভুক্ত সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হবার সম্ভাব্য সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬-এর নিষিদ্ধ কার্যক্রসমূহ দণ্ডনীয় অপরাধ।
দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ‘প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় সমাজভিত্তিক অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। টাঙুয়ার হাওড়ের প্রতিবেশ সুরক্ষায় পূর্বে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সমুদ্র প্রতিবেশ সংরক্ষণ, সমুদ্রদূষণরোধ, সমুদ্রসম্পদ আহরণে ও সমুদ্রসম্পদের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্লু-ইকোনোমি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সমুদ্র জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশসম্পদ জরিপ সম্পাদনের লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
পাহাড় কর্তন রোধকল্পে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর সংশোধনীতে (২০১০ সালে আনীত) পাহাড় কাটা বন্ধের লক্ষ্যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে পাহাড় কর্তনরোধে নিয়মিত মনিটরিংসহ গণসচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
দেশের সামগ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুনভাবে গৃহীত জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮-তে পূর্বের ১৫টি খাতসহ আরও ৯টি খাত/ক্ষেত্রের মধ্যে পাহাড় প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ এবং জীবনিরাপত্তা, প্রতিবেশবান্ধব পর্যটন, ইত্যাদি খাতসমূহকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোট ২৪টি খাতে অন্তর্ভুক্ত কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাসমূহকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাসমূহ কর্তৃক বাস্তবায়িত হতে হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং এর টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭ জারি করা হয়েছে। জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত জীবের গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ জীবনিরাপত্তা বিধিমালা ২০১২ ও জীবনিরাপত্তা গাইডলাইন ২০০৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। জীবনিরাপত্তা বিষয়ে সামর্থ্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি অত্যাধুনিক GMO Detection Lab প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গৃহীত আন্তর্জাতিক কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১১-২০২০ (যা আইচি বায়োডাইভারসিটি টার্গেটস হিসাবে অভিহিত)-এর আলোকে জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা, ২০১৬-২০২১ (National Biodiversity Strategy and Action Plan, NBSAP 2016-2021) প্রণীত হয়েছে। দেশের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বেশ কিছু এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় অভ্যন্তরীণ এবং সামুদ্রিক জলাভূমির ১৩ টি এলাকাকে (৩৮৪৫.২৯ বর্গকিলোমিটার) প্রতিশেগত সংকটাপন্ন এলাকা, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর আওতায় ৪৮টি বনজীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকাকে (৪৬৭০.৭৭ বর্গকিলোমিটার) রক্ষিত এলাকা এবং বঙ্গোপসাগরে ১টি সামুদ্রিক রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে। এ এলাকাসমূহের অনেকগুলোর ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে।
নদনদীর প্রতিবেশ সংরক্ষণে শিল্প-কারখানার তরলবর্জ্য হতে নদ-নদী দূষণ রোধে সরকার তরল বর্জ্য উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানার জন্য Effluent Treatment Plant (ETP)-এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত দেশের ২০৪৬টি তরলবর্জ্য উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানা ETP/ইটিপি স্থাপন করেছে, যা মোট তরলবর্জ্য উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানার ৮১.৩১%। এ ছাড়াও ৬০৫টি তরলবর্জ্য উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানার অনুকুলে Zero Liquid Discharge (ZLD) Plan অনুমাদন করেছে। শিল্পকারখানার দূষণ রোধে ২০১৬-১৭ হতে ২০২০-২১ পর্যন্ত মোট ৫১৩১ টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। পরিবেশ দূষণের দায়ে এই প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে ১৮৫.১৯ কোটি টাকা জরিমানা ধার্য্য করা হয়েছে এবং ৬২.০৯ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে।
হালদা নদীর দূষণরোধে ২ (দুই) দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মাছের ডিম পাড়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্প/কারখানা দ্বারা দূষণ রোধে ঢাকার চারপাশের (০৪) বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ নদীকে সুরক্ষা ও পরিবেশ ও প্রতিবেশের উন্নয়নের জন্য প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ কমাতে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পসমূহ কেন্দ্রিয় বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপনপূর্বক ঢাকার বাইরে সাভারের হরিণধারায় অবস্থিত ঢাকা চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করা হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীতে চামড়া শিল্পের দূষণ পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ৬৪ (চৌষট্টি) টি ওয়াশিং কারখানার কার্যক্রমও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্প-কারখানায় এয়ার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করেছে। এছাড়াও অবৈধ ইটভাটাসমূহ বন্ধ করাসহ ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি নির্মাণ কাজে আগামী ২০২৫ সাল হতে ব্লক ইটের ব্যবহার ১০০ ভাগ করার জন্য নির্দেশনাসম্বলিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। রাস্তার ধুলাবালিসৃষ্ট বায়ুদূষণ রোধে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। শব্দদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, পরিবেশ সংরক্ষণে জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কার্যক্রমসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা, একনিষ্ঠতা, সুদূরপ্রসারী দিক নির্দেশনা সর্বোপরি বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য তিনি ২০১৫ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার, ÒChampions of the EarthÓ অর্জন করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৃহীত ‘২০৩০ এজেন্ডা ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’ অর্জনে সকল মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করার লক্ষ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে প্রতিবেশ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণে একটি অগ্রগামী দেশে পরিণত হয় সেলক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-এর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সরকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP, 2009) প্রণয়ন করেছে। BCCSAP তে ৬টি থিমের আওতায় প্রায় ৪৪ টি প্রোগ্রাম-এর অধীনে উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ৩৮০০ কোটি টাকা এ তহবিলে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং ৭৮৯ টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এ প্রকল্পসমূহের মধ্যে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার বিষয়ক প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতকরণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সকল উন্নয়ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাসমূহের বাজেটে সুনির্দিষ্ট আর্থিক সংস্থান অন্তর্ভুক্ত করে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই একটি ভবিষ্যত। আমাদের প্রজন্মের সকলের সমবেত এবং শক্তিশালী প্রচেষ্টাই পারে প্রতিবেশকে অক্ষুন্ন এবং সমৃদ্ধ রেখে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। হারানো প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই আমরা এ ধরিত্রীকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবো। তাই, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারই হোক আজকের প্রজন্মের একমাত্র অঙ্গীকার।
লেখক : মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর