নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাদকের আখড়া

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাদকের আখড়া

ঘুষ দিয়ে জমি-বাড়ি বরাদ্দের অভিযোগ
৮০টি বাড়িতে ভাড়াটিয়া
দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দরিদ্র বাসিন্দারা

মাহবুব আলম প্রিয়, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) ।। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভার বিরাবো খালপাড়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৩৫০টি সরকারি বাড়ির মাঝে ভাড়া দিয়ে উঁধাও প্রায় ৮০টি পরিবার।

এখানে ঘর বরাদ্দে মানা হয়নি সরকারের দেওয়া ভূমিহীন শর্ত। আবার দরিদ্রদের ঘরে হানা দেয় মাদককারারি। অভ্যন্তরীন রাস্তায় দেখা গেছে জলাবদ্ধতা।

এছাড়াও ঘর ভেঙে যাওয়া, জামে মসজিদ না থাকা, সীমানা প্রাচীর ও কবরস্থান না থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সরকারি বাড়ির বাসিন্দারা৷ অভিযোগ রয়েছে, লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে জমি ও বাড়ি বরাদ্দ পাওয়ার। সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনায় সারা দেশে হতদরিদ্র ও ভূমিহীনদের স্থায়ী আশ্রয় দিতে ২শতক জমিসহ একটি আধাপাকা বাড়ি উপহার দেয়া হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও এমন প্রকল্পে স্থান পেয়েছেন প্রায় হাজারের অধিক ভূমিহীন। তবে কাঞ্চন পৌরসভার বিরাবো খালপাড়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। এখানে বরাদ্দ প্রদানে মানা হয়নি ভূমিহীন থাকা শর্ত। ফলে বরাদ্দ পাওয়া ৩৫০টি বাড়ির মাঝে প্রায় ৮০ টি ঘরে বসবাস করছেন ভাড়াটিয়া।

অনেকেই গত ৪ বছর ধরে বসবাস করেন না। কিন্তু ঘর নিয়ে রেখেছেন নিজেদের নামে। তালা ঝুলিয়ে মাঝে মাঝে সরকারি অনুদান এলেই কেবল আসেন। আবার অনেকে জমি-জমা থাকলেও পেয়েছেন সরকারি বাড়ি।

এমনকি টাকা দিয়ে ২টি বাড়ি একাই নিয়েছে মাদককারবারি হিসেবে পরিচিত আবুল হোসেন ও তার বোন। দেখা গেছে, কোন ঘরে বরাদ্দ ছাড়াই থাকেন অস্থায়ী মসজিদের ইমাম সাহেব ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের স্বজন।

১১০ বছর বয়সী ফুলবানুও একটি সরকারি ঘর পেয়েছেন। তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অভ্যন্তরে দিনে দুপুরে মাদকসেবীদের আনাগোনায় বিরক্ত হলেও এসব নিয়ে কথা বলতে রাজি নয় তিনি। তবে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছেন সব।

কথা হলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের মতো ভূমিহীনদের বাড়ি দিয়েছেন, জমি দিয়েছেন এর চেয়ে আর কি পাওয়ার আশা করবো। যা জুটাতে পারি তাই খাই। সরকারি ঘরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, এখানকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই।

গত ৪ বছরে ভেঙে গেছে ঘরের পিলার, ফাটল ধরেছে দেয়ালে, বর্ষা এলে থাকে চলাচলের রাস্তায় জলাবদ্ধতা, সীমানা প্রাচীর না থাকায় রাত হলেই থাকে বহিরাগত মাদককারবারিদের উৎপাত। আবার স্থায়ী মসজিদ না থাকায় এবাদতে সমস্যা, কবরস্থানের অভাবে বিপাকে রয়েছি আমরা।

অভিযোগ রয়েছে, এ প্রকল্পের বাসিন্দা মাদককারবারে জড়িত আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা আবুল হোসেনসহ একাধিক চক্রের দৌড়াত্ম্যে আশপাশের গ্রামের লোকজন নদীর পাড়ে বসে গাঁজা ও ইয়াবা সেবন করে প্রকাশ্যে।

এসব বিষয়ে বিগত সময়ে অস্থায়ী মসজিদে গাঁজা রেখে ব্যবসা করার সময় আবুল হোসেনকে গ্রেফতার করে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ মামলা দেয়। পরে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের মাদককারবার চালিয়ে যায়৷ এসব নিয়ে সচেতন বাসিন্দারা ভোলাবো তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ সদস্যদের জানালেও কর্ণপাত করেননি তারা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের নিরাপত্তায় কখনো টহলও দেন না বলে অভিযোগ করেন নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা। তাদের দাবি, ভোলাবো তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর রেজাউল করীম কখনো এ প্রকল্পের খোঁজ নেননি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলাব পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর রেজাউল করীম বলেন, এখানে মাদককারবারি আছে, এমন কিছু জানা নাই। তাই যাওয়া হয়নি।

সাবেক কাউন্সিলর হোসেন মিয়াকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়েও বাড়ি না পাওয়ার ক্ষোভে রাবিয়া বেগম নামীয় জাঙ্গীরের বাসিন্দা লিখিত অভিযোগ করেছেন রূপগঞ্জ উপজেলা ইউএনওর কাছে। দালাল গিয়াসউদ্দিন ও হোসেনদের টাকা দিলেই মিলতো বাড়ি। এমনটাই অভিযোগ পত্রে লিখেন তিনি। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তারা।

তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাদকের ছড়াছড়ির কথা স্বীকার করেছেন কাউন্সিলর হোসেন মিয়া। কাঞ্চন পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর হোসেন মিয়া বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে আমি কাউন্সিলর থাকাকালীন মাদক নির্মূলে কাজ করেছি। আবুলকে গাঁজাসহ ধরার পর মামলা হয়েছে। এখানে অস্থায়ী মসজিদ করে দিয়েছি। তবে আরও নানা সমস্যা রয়েছে।

তার বিরুদ্ধে রাবিয়া বেগমের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, রাবিয়া পরকিয়া সংক্রান্ত ঝামেলায় জড়িয়ে সরকারি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাকে বাড়ি পাইয়ে না দেয়ায় আমার প্রতিপক্ষের কেউ ফুঁসলিয়ে একটি অভিযোগ দিয়েছে।

এ বিষয়ে ফোনে জানালেও আমাকে কেউ ডাকেনি। এদিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাছেই রূপগঞ্জ থানা পুলিশের ভোলাবো তদন্ত কেন্দ্রের অবস্থান থাকলেও সেখানকার ইনচার্জ রেজাউল করীম জানেন না মাদকের ছড়াছড়ির খবর।

অথচ এখান থেকেই ডিবি সদস্যরা গাঁজাসহ মাদক উদ্ধার করেছেন একাধিকবার। তাই স্থানীয়রা অনাস্থা জানিয়েছেন এ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ রেজাউল করীমকে। এদিকে সরকারি ঘর পেতে টাকা লাগে না তাই জড়িতদের ব্যবস্থা, মাদক বিষয়ে তৎপরতা আর অনিয়মের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

রূপগঞ্জ ইউএনও আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিহীনদের আশ্রয় দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের অধীনে যারা আছেন তাদের সাহায্য করা হচ্ছে।

তাদের দুর্ভোগ যা আছে আস্তে আস্তে সমাধান করা হবে। তবে মাদকের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। শিগগিরই অভিযান করবো। আর সরকারি বাড়ি পেতে কেউ টাকা নিয়ে থাকলে প্রমাণ হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে এমন অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত চলছে। আর ভাড়া দেওয়ার ঘটনাও দেখবো৷

এদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বললে তারা জানান, ভূমিহীন ও হতদরিদ্রদের সরকারী আশ্রয়স্থলে মাদকমুক্ত পরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও দুর্ভোগ লাঘবে এগিয়ে আসতে সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও জনপ্রতিনিধিদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন৷ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের দাবিও রয়েছে।

স/এষ্