মহান ভাষা আন্দোলন, এগিয়ে চলা ও প্রত্যাশা

মহান ভাষা আন্দোলন, এগিয়ে চলা ও প্রত্যাশা

সুদীপ চন্দ্র হালদার: ঝর্ণা যেমন পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বনাঞ্চল, তেপান্তর পেরিয়ে বৃহৎ নদীতে পরিনত হয়, ঠিক তদ্রুপ আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে আজকের অবস্থানে এসেছে। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবার হতে পন্ডিত প্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ উদ্ধার করেন। চর্যাপদে প্রাচীনকালের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে যা বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।

বাংলা ভাষা আমাদের প্রানের ভাষা, এই ভাষার রস পান করেই আমরা শৈশব হতে প্রানবান হয়ে উঠেছি। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুর চলমান প্রবাহ এই ভাষার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে।

১৯৪৭ সালে ভিনদেশীদের অপরাজনৈতিক চক্রান্তে প্রায় এক হাজার মাইল দূরের দুটি ভিন্ন ভূখণ্ড নিয়ে একটি ভ্রান্ত মতবাদকে পুঁজি করে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। এই দুই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে ছিল না ভাষাগত মিল, ঐতিহ্যগত মিল, ঐতিহাসিক মিল, নৃতাত্ত্বিক মিল ইত্যাদি। এই ব্যর্থ রাষ্ট্রটি গঠিত হলে শাসকেরা তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্বার্থে চেয়েছিল আমাদের সংস্কৃতি নষ্ট করতে; কারণ, কোন জাতিগোষ্ঠীকে দমন করতে হলে নিজস্ব স্বকীয়তা রূপ সংস্কৃতিকে নষ্ট করতে হয়। সংস্কৃতিতেই লুকিয়ে থাকে একটি জাতিগোষ্ঠীর হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, দর্শন, হাসি-কান্না তথা প্রাণের স্পন্দনের সকল উপাদান। আর, সংস্কৃতি প্রবাহমান থাকে ভাষার মধ্য দিয়ে। তাই, পাকিস্তানিরা প্রথম আঘাত করেছিল আমাদের মাতৃভাষাতে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্নাত রাজপথের দাবি সফল হয়েছিল ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রাণের ভাষা বাংলাকে পেয়ে, আর পূর্ণতা পেয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর মহান ভাষা শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য এরূপ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, আন্দোলন অতি বিরল। মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন আমাদের হৃদয়ের চেতনাকে উর্বর করেছিল, পরবর্তীতে সংঘটিত বাঙালি জাতির সব আন্দোলন- সংগ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে রোপিত হয়েছিল; যার ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতি দীর্ঘ পরাধীনতা, ভিনদেশীদের রক্তচক্ষুময় শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন করে স্বপ্ন দেখেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের তথা অর্থনৈতিক মুক্তির; কিন্তু, বর্বর-কুচক্রীদের দ্বারা নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ায় বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্ন অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের [আইএমএফ] হিসাব অনুযায়ী বর্তমান রিজার্ভের পরিমান ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় বর্তমানে প্রায় তিন হাজার ডলার, দেশে একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে, ইতিমধ্যেই বেশ কিছুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে, সুদূর গ্রামে বিদ্যুৎ পৌছে গেছে, রাস্তাঘাটের অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে, বিশুদ্ধ পানীয় জল ঘরে ঘরে পৌছে গেছে। প্রকৃতিপ্রেমী কবি সাহিত্যিকদের গ্রামের মেঠোপথ আর কলসি কাখে জল আনতে যাওয়া রমনী খুজে পেতে হন্যে হয়ে আজ ছুটতে ছুটতে ব্যর্থ হতে হয়। এটাই বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের ফলাফল।

নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেশ বাংলাদেশ; এখানে, অধিক ঠান্ডা বা গরম নেই, প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক, এখানকার মানুষের মন মানসিকতাও মধ্যম প্রকৃতির। এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মসচেতন; তবে, ধর্মান্ধ কিংবা মৌলবাদী নয়, ধর্মসচেতন এই সকল মানুষদের অল্প সংখ্যক ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের প্রতিহত করে সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে রাষ্ট্রের চলমান উন্নয়নের ধারা সুসংহত রাখতে হবে। তবেই, বাংলাদেশ পরিনত হবে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে, সত্যিকার রোল মডেল হবে পৃথিবীর কাছে। আশা করি, সেই লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যাওয়া চলমান থাকবে সকল আন্দোলন সংগ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর স্বরূপ ভাষা আন্দোলনের চেতনা হৃদয়ে ধরে অবিরাম, নিরন্তর।

সুদীপ চন্দ্র হালদার, রাজনৈতিক
[শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক সম্পাদক,
বাংলাদেশ তাঁতী লীগ, ঢাকা মহানগর দক্ষিন।]
রিসার্চ স্কলার [আইন]