আমাদের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে

১৯৮৮-৮৯ সালে যখন ছাত্রলীগের মিছিল মিটিংয়ে যাওয়া শুরু করলাম, তখন আওয়ামী লীগ থেকে পাওয়ার ছিল না কিছুই। নব্বইয়ের আন্দোলনে শতভাগ সক্রিয় ছিলাম। একানব্বইয়ের নির্বাচনে রাত দিন কাজ করেছি। ওই নির্বাচনে পরাজয়ের পর ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দেশে ছিলাম। এরশাদ এবং খালেদার জিয়ার আমলে শুধুই অত্যাচারিত হয়েছি। মামলা খেয়েছি। বন্ধু নওফেলকে হারিয়েছি। পাওয়ার মধ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজেদা চৌধুরীর একটি বিবৃতি পেয়েছি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ জীবনে ক্ষমতায় আসতে পারবে কিনা এ আশংকা ছিল সবার মনেই। হয়রানি আর অন্ধকার ভবিষৎকে সামনে রেখেও আওয়ামী রাজনীতি ত্যাগ করেনি লাখ মুজিব সৈনিক। কারণ একটাই ছিল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। বর্তমান সময়ে অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন ৩০/৪০ বছর ধরে রাজনীতি করে কিছুই পেলাম না! আর আমি বলি, আমি এত বছর রাজনীতি সাথে জড়িত থেকে নব্বই ভাগই পেয়েছি। যখন ’জয় বাংলা’ ’জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে শ্লোগান দেওয়া শুরু করি, তখন যা পেতে চেয়েছি-
১. প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখবো।
২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।
৩. বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে।
৪. বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হবে আর অর্থনৈতিক মুক্তি পাবে দেশ।
অধিকাংশই পেয়েছি। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখিনি। তার শেষ সময়ে আমার জন্ম হয়েছে। বাবা-চাচার কাছ থেকে শুনে আর বই পড়ে বঙ্গবন্ধু প্রেমী হয়েছি। বাংলাদেশের প্রতি তার ভালবাসা দেখে তার আদর্শের সৈনিক হয়েছি। আজকের দিনের সৈনিকদের মত নয়। ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, এমনটিও নয়। যদি তাই হতো, তাহলে জাতীয় পার্টি বা বিএনপির সৈনিক হতাম। কারণ সমবয়সী বন্ধুরা অধিকাংশই ওই দলগুলোর সমর্থক ছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসা থেকে তার আর্দশের প্রতি দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার বিকল্প নাই। সেই চিন্তা থেকেই জননেত্রীর প্রতি ভালবাসা। কারণ, আমরা যখন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যাত্রা শুরু করি, তখন তার মধ্যে আজকের মত রাজনৈতিক বিচক্ষণতার ভাব ছিল না, ছিল না কোনও সফলতা। বরং ৯১ এর নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ব্যর্থতার দায়ে তিনি দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে চেয়ে ছিলেন। নেতা-কর্মীদের বাধা আর ভালবাসার মুখে তিনি পরিবর্তন করেন তার সিদ্ধান্ত।
এরপর অনেক চড়াই, অত্যাচার-নির্যাতন আর ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনেন। ক্ষমতায় আসার পর পরই দল একটু একটু করে দূরে চলে যেতে থাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে।  ফলাফলটাও পেয়ে যায় হাতেনাতে ২০০১ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর প্রায় ৩০ হাজার আওয়ামী নেতা কর্মী নিহত হন স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত বিএনপির হাতে। গ্রেনেড হামলার শিকার সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসেন সভানেত্রী নিজে। ওই হামলায় আইভী রহমানসহ ২৪টি তাজা প্রাণ ঝরে যায়। কিন্তু কেন?
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে যদি রাষ্ট্রপতির চেয়ারসহ অন্যান্য জায়গায় দলীয় লোককে বসানো হতো তাহলে এত রক্ত ঝড়ে পড়তো কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে? কাদের ভুল সিদ্ধান্তে আওয়ামী কর্মীদের এত ত্যাগ?
৫ মে ২০১৩ সাল, হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ছিল। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকগুলো সংগঠন ওই দিন হরতাল ডেকে ছিল। ওইদিন আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে বা গোপনে ওই হরতালকে সমর্থন করেছে বলে জানা নাই। যদি তারা তা করতো তাহলে মতিঝিলে দিনে এবং রাতের বেলার ঘটনা ঘটতো কিনা সন্দেহ আছে। ওই সময়ে আমি ঢাকাতেই ছিলাম। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে আওয়ামীপন্থি ডাক-সাইজের এক বুদ্ধিজীবীকে কল করে জানতে চাইলাম পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে আর আমার কী করণীয় আছে!
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, “সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওদের ঢাকায় ঢুকতে দিয়েছে, এখন তারাই ঠিক করবে কী করণীয়।” তবে তোমরা জেগে থেকো, বাসা থেকে যেকোনও সময় বের হয়ে আসতে হতে পারে। পরবর্তী ঘটনা সবার জানা। ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তদন্তে ওই সময়ে তিনদিন ধরে মৌলবাদীদের সাথে সংঘর্ষে সারা বাংলাদেশে ৬০ জনের উপরে মানুষ নিহত হয়েছে বলা হয়েছে। এই যে ৬০টি মায়ের বুক খালি হলো তা কাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে?
গণতন্ত্রের কথা বলে, বাংলাদেশের অধিবাসী বলে মৌলবাদীদের আর কত ছাড় দেওয়া হবে? যারা মানবতা বোঝে না, গণতন্ত্র বোঝে না, এমন কি ধর্ম সর্ম্পকে যারা নিজ স্বার্থকেই বোঝে তাদেরকে এত ছাড় দিতে হবে কেন? কিসের আশায়? দেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং দেশ উন্নয়নে এই মৌলবাদীদের কোন ভূমিকা আছে কি? তাহলে কেন এত ছাড় দিতে হবে তাদেরকে? কওমী স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও কোন কওমী মাদ্রাসায় আজ পর্যন্ত জাতীয় সংগীত বাজানো হয়েছে কি? সরকারের কোনও লোক কওমী মাদ্রাসায় প্রবেশ করতে পারে কি? এমন হাজারো প্রশ্ন আজ ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু বই পড়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী লাখ বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের মনে।
আজ আমাদের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। যখন দেখি মৌলবাদীরা প্রকাশ্য জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দেয়। আর তা শুনে আওয়ামী নেতারা মুখে কুলুপ এটে বসে থাকে! আওয়ামী সরকার ক্ষমতায়, সংসদ নেত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা অথচ এই মুজিব বর্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ‘এডিট’ করে বাজানো হয়, কিন্তু কেন? ওই মৌলবাদীদের ভয়ে? নতুবা সংসদে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ওই বক্তব্যে কেন ধর্মনিরপেক্ষতার অংশটুকুই ‘এডিট’ করা হবে!
গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট দশ শতাংশেরও কম। আর এই দশ শতাংশ ভোট কখনোই বাংলাদেশের হবে না, আওয়ামী লীগের হবে না। এই দশ শতাংশ ভোটার কখনোই বাংলাদেশ উন্নয়নে কাজে লাগবে না। এরা দেশের শত্রু, ধর্মের শত্রু। এরা স্বাধীন বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য হুমকিই শুধু নয়, মস্তবড় বোঝাও বটে। তারপরেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের কাঁদিয়ে এদের এত ছাড় দিতে হবে কেন?
গত কয়েকদিন মৌলবাদীদের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ স্যোসাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে একটির বক্তা জোর গলায় বলছে, ’বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে’! সময়ের সাথে সাথে আমাদের আরো অনেক কিছুই হয়তো শুনতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ভাই বলেছিলেন, “বিএনপি বা অন্য কোন রাজনৈতিক দল মোকাবেলা আওয়ামী লীগের জন্য সমস্যা নয়। আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে ধর্মীয় মৌলবাদীরা। তাদের মোকাবেলা করাটা হবে খুবই কঠিন।”
তার সে কথার সূত্র ধরে আর বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ মৌলবাদীদের কাছে পরাজয় বরণ করে তাদের সাথে আপস করে চলছে। তাই আজ আমার মত লাখ মুজিব সেনার শঙ্কিত মনে একটি প্রশ্নই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ কি তাহলে ‘আওয়ামী মুসলীম লীগ’ হতে চলেছে!