বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফ্লাইট যেভাবে সঙ্কুচিত করে দিচ্ছে চীন
নিজস্ব প্রতিবেদক: পাকিস্তানের চলমান বর্বরতার মধ্যেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও বিমান সদস্যদের বিদ্রোহের ফলে ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (বিএএফ) আত্মপ্রকাশ করে। প্রাথমিকভাবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রায় এক হাজার বাঙালি সদস্য যারা সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিল তাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তারা বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিএএফ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য অনুদান পায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পাওয়া এয়ারক্রাফট বা বিমানের মধ্যে ছিল দশটি মিকোয়ান-গুরেভিচ মিগ-২১ এমএফএস, দুটি টুইন-সিট মিকোয়ান-গুরেভিচ মিগ-২১ ইউএমএস এবং বারোটি মিল এমআই-৮8ইউটিলিটি হেলিকপ্টার। দেশের আকাশসীমা রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিরোধক বাহিনী হিসাবে কাজ করার মধ্যদিয়ে সীমানাকে সুরক্ষিত করার বাংলাদেশি দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ।
বাংলাদেশ ফোর্সেস গোল বা লক্ষ্য-২০৩০ এর অধীনে বিএএফের একটি উচ্চাভিলাষী আধুনিকীকরণ পরিকল্পনা রয়েছে যা আগামী বছরগুলিতে বাস্তবায়ন করা হবে। লক্ষ্য অনুযায়ী বিমান শক্তি এবং স্থল ভিত্তিক বিমান প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উভয়কেই শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই লক্ষ্য প্রণয়নের পর থেকে বিএএফ নিজেকে নানাভাবে উন্নত করেছে। বিমান বাহিনী ১০৫ অ্যাডভান্স জেট ট্রেনিং ইউনিট নামে একটি উন্নত প্রশিক্ষণ ইউনিট স্থাপন করেছে যা বিএএফ-এর একটি নিবেদিত ফাইটার পাইলট প্রশিক্ষণ ইউনিট। ইউনিটটিতে তিনটি প্রশিক্ষণ স্কোয়াড্রন রয়েছে যা যুদ্ধবিমান পরিচালনার জন্য নির্বাচিত পাইলটদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করবে।
বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নষ্ট করার জন্য একটা ক্রমবিকাশমান ধারার উদ্ভব হয়েছে। চীনের প্রতিরক্ষা সরবরাহের ওপর বিমান বাহিনীর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা, এমনকি মৌলিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তার জন্য বাংলাদেশকে চীন তার দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করছে। সাম্প্রতিক কেনাকাটায় চীনের সরবরাহ করা ব্যপক সংখ্যক ত্রুটিযুক্ত নিম্নমানের হার্ডওয়ার পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০২০ সালে কেনা ৭ কে-৮ডাব্লিউ এয়ারক্রাফটের সমস্যা এই ইস্যুকে সামনে তুলে ধরেছে। এই এয়ারক্রাফটগুলো বাংলাদেশে আসার পর থেকেই এর ত্রুটির খবর পাওয়া যাচ্ছে। উপরন্তু ২০১৪-১৫ সালে বিএএফের কেনা কে-৮ডাব্লিউ এয়ারক্রাফটের রেডিও সিস্টেম ত্রুটিযুক্ত, এগুলো পরবর্তীতে চীনের রিপ্লেস করার কথা।
চীন থেকে কেনা পিটি ৬ বিমানের অবস্থা আরেকটি দুঃখজনক বিষয়। এগুলোর অনেক ইঞ্জিনকে জরুরিভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে হবে কারণ বিমানগুলো গ্রাউন্ডেড অবস্থায় পরে আছে। একইভাবে, চীনের সরবরাহকৃত নিম্নমানের রাডারগুলি বিএএফের জন্য মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। এগুলোর সাপের্টিং হার্ডওয়্যার পরিস্থিতিও সমানভাবে উদ্বেগজনক যা বিভিন্ন চীনা সরবরাহকারীর কাছ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ সহায়তার অভাবে পড়ে আছে। এরফলে বিএএফে যন্ত্রপাতির স্তুপ জমা হচ্ছে, এগুলো মেরামতের জন্য চীনা সাড়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে।
বাংলাদেশ কেবল প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যার সংগ্রহের জন্যই নয় এগুলোর মেরামত/রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়মিত এগুলোর শুন্যস্থান পুরনের জন্য চীনের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে বলে মনে হয়। এই অবস্থা দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশে চীনাদের একটা বড় উপস্থিতি তৈরির দিকে ঠেলে দিচ্ছে যা একটা দেশের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। তদুপরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ক্রমবর্ধমান ব্যয় বিবেচনায় চীনের উপর উচ্চ নির্ভরতা দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটের উপর অতিরিক্ত প্রভাব ফেলছে। বর্ধিত অবতরণ সময়সহ এইসব ত্রুটি বিচ্যুতি পরিচালন ক্ষমতাকে মারাত্বকভাবে ব্যহত করছে যা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সার্ভিসের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে। এসব কারণে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, দেরি হলেও বাংলাদেশ সম্প্রতি চীন ছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করে এক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনায়ন করছে। যত দ্রুততার সাথে বাংলাদেশ এদিকে এগোবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে।
এস/এ