শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তানরা, প্রত্যাশিত বাংলাদেশ পাইনি

শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তানরা, প্রত্যাশিত বাংলাদেশ পাইনি

বিশেষ প্রতিনিধি: স্বাধীনতার ৫০ বছরেও প্রত্যাশিত বাংলাদেশ পাইনি বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানরা। তারা বলেছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে বাংলাদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, সেটি আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও দেশে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি তৎপর। একটি শ্রেনী ধর্মকে নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা করছে। এখনও বঙ্গবন্ধুর ৭২’র সংবিধানের মূল চার নীতিতে ‘তীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরে যেতে পারিনি। এটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বাবা যে জন্য জীবন দিয়ে গেছেন, সেটি পাইনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ছিলো না। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তরুণরা পায়নি। এখনও দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনা পরিপূর্ণতা পায়নি। শ্রেণী বৈষম্য রয়েছে। যেখানে জাতিয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি দেশ গঠনের কথা ছিলো, সেটি কিন্তু এখনও হয়নি। এমনকি ৭৫’র পরবর্তী সরকারগুলো ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা বোঝানোর চেষ্টা করেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে তারা আছে। তারা দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। সেই পাকিস্তানের প্রেম তারা ছাড়তে পারেনি। তাই নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানে না। ফলে বাঙালি জাতিসত্তা কি, তার সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তরুণরা।

তিনি বলেন, যারা দেশের বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তাদের অবদান জাতির কাছে স্পষ্ট। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে সংবিধান দিয়ে গেছেন, সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, ধর্ম পালন করবে ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী দল আওয়ামী লীগ, তারাও এদেশে হেফাজতে ইসলামকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাদের সঙ্গে আমরা আপোসকামীতা দেখেছি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্ককর্যের ওপর আঘাত হেনেছে। সম্প্রতি যে কয়টি সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে, তা গত ১০ বছরেও হয়নি। বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ফসল ৭২’র সংবিধানের চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আমরা ৭২’র সংবিধান থেকে সরে এসেছি। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ রাখা হয়েছে। এখনই উচিত বঙ্গবন্ধুর ৭২’র সংবিধানের চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করা।

শহীদ জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান বলেন, যে চেতনা নিয়ে বাবা শহীদ হয়েছেন, সেটি বাংলাদেশের ৫০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। দেশের যে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, এই দলের সহযোগি ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সঙ্গে যারা আছেন, তারা ৭ মার্চের ভাষন শুনেন। কিন্তু তারা বাঙালীর জাতি সত্তার ইতিহাস জানেন না। ফলে তাদের মধ্যে কমিটমেন্ট নেই। এর বাইরেও বিএনপি, জাতীয় পার্টি তারা তো নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোয় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আর জামায়াত তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। এছাড়া নাম কোয়াস্তে কিছু বাম সংগঠন রয়েছে, তারা তো এগুলো নিয়ে কথা বলে না। এ জন্য প্রগতিশীল মানুষদের একাট্টা হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সেটি হয়নি। এখন শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয়, ১৯৪৭-১৯৭১ সালের ইতিহাস তুলে আনা উচিত। একমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। যেখানে মাদ্রাসায়ও রবীন্দ্রনাথকে পড়ানো হবে। ইংরেজি মাধ্যমেও রবীন্দ্রনাথকে পড়ানো হবে। তাহলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবো। এক কথায় শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।

শহীদ আলতাফ মাহমুদের কণ্যা শাওন মাহমুদ বলেন, আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি ভূখন্ড পেয়েছি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি পেয়েছি। কিন্তু একটি অসাম্প্রদায়িক দেশের জন্য বাবা আত্মত্যাগ করে গেছেন। সেটি কিন্তু আমরা এখনও পাইনি। সেই উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি এখনও রয়েছে। এটি আমাদের বড়র অপ্রাপ্তি। আমরা ফেল করেছি। এতো বেশি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি দেশে ভর করেছে, এখান থেকে উত্তরণ খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, তবে দেশের যারা নীতি নির্ধারক, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিকে নিমূল করার নীতি নির্ধারণ না করতে পারবেন, ততদিন আমাদের এই বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। এ জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মেয়ে মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, এখনো মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করে অনেক কথাই শুনছি। আমার বাবা যে দেশটির জন্য শহীদ হয়েছেন, তার কিছু পেয়েছি। তবে অনেকটাই অপূর্ণতা রয়েছে। এরমধ্যে দেশের আইন-কানুন ও ন্যায়নীতি বান্ধব হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সেটি এখনও হয়নি। আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, কোর্টের বিচার সময় মতো সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন না। দেশে সহিংসতা রোধ করা এখনও সম্ভব হয়নি। সব চেয়ে বড় কথা দেশে সমতা আনা, সেটি শুধু নারী-পুরুষই নয়। সব ক্ষেত্রে সমতা আনা জরুরি।

তিনি বলেন, দেশে এখনও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রয়েছে। আমার বাবা শহীদ হয়েছেন, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মানের জন্য। কিন্তু আজও দেখছি তারা দেশে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়াচ্ছে। দেশে তারা বিভিন্ন সময়ই মাথা নাড়া দেয়। এগুলো নিরসন করা খুব জরুরি। এজন্য প্রয়োজন যারা ক্ষমতাসীন, তাদের আরও সোচ্চার হওয়া। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের এখানে বড় একটি সমস্যা রয়েছে। তারা চায় না, ক্ষমতা হারাতে। তাই তারা অনেক কিছু এড়িয়ে যান। যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা জমিদখল, চাকরি দখল করেন। তাদের সঠিক বিচার করতে হবে। শুধু সমাজ নয়, এর দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সামাজিক মেইল বন্ধন তৈরি হওয়া জরুরি। শিক্ষার মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। এটি সবাই মিলে করতে হবে।  

এস/এ