হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আর কত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে

সমীরণ রায়

হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আর কত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে

সমীরণ রায়

গত ১৪ অক্টোবর থেকে জ্বর। শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা। সঙ্গত কারণে লেখার ইচ্ছে থাকলেও লিখতে পারছিলাম না। কিন্তু আজকে আর না লিখে পারলাম না। আজ ২০ অক্টোবর লক্ষ্মী পূজা, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, প্রবারনা পূর্ণিমা এক দিনে। এর চেয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর কি হতে পারে। আমরা সবাই এক সঙ্গে মিলে উৎসব পালন করছি। তারপরেও দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত। যদিও আমি ভীত নই। কারণ আমি বাঙালি। আমরা বীরের জাতি। বাঙালি জাতি কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ভয় পায় না। তাই আমিও পাই না। কিন্তু কুমিল্লায় নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজা মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি আমাকে বিস্মিত করেছে। আমি হতবাক হয়েছি। আমি ভয় পেয়েছি। সেই ভয় এখনও আমাকে পিছু ছাড়ছে না। আমি ঘুমাতে পারছি না। ভীষণ ভয় ভয় লাগছে। আবার কার বাড়ি
-ঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেবে। কোন মায়ের বুক খালি হবে। মায়ের আর্তচিৎকারে জন্মভূমি কেঁপে উঠবে। এখন ভয় নিত্যদিনের সঙ্গী হয়েছে। পত্রিকায় দেখলাম, মানুষ সবকিছু হরিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। রংপুরের পীরগঞ্জে চারদিকে পোড়া গন্ধ। মাটি পুড়ে লাল হয়ে গেছে। কিন্তু পোড়েনি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হৃদয়। বাচ্চারা ভাতের অভাবে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মন গলেনি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর। বরং সাম্প্রদায়িক শক্তির বীভৎস রূপ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। হিন্দুদের মন্ডপ, বাড়ি-ঘর, সুন্দরী নারী ও লুটপাট এখন তাদের টার্গেট। মা-মেয়েকে ধর্ষণ করছে। মায়ের সামনে মেয়েকে অপমান করা হয়েছে। সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এক একটি পরিবারকে। কিন্তু কান্না শোনার যেন কেউ নেই।

গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজা মণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগে এনে হামলার ঘটনাকে ধিক্কার জানানোরও ভাষা নেই। শুধু হামলা নয়, ভাংচুর, খুন, লুটপাটসহ এমন কোনো ঘটনা নেই, যা ঘটেনি। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা-বাহিনীর লোকজন কি করছিলেন? সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। এই সংস্থাগুলো কি করছিল? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবিদার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কী আঙুল চুষছিলেন? তারা যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বুকে নয়, মুখে বলে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেন। আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন, তাহলে আপত্তি আছে। তার মানে বুঝতে হবে চেতনায় মরিচা ধরেছে।

এতোগেলো কুমিল্লার ঘটনা। কিন্তু পরে নোয়াখালীর ঘটনাকে আরও বেশি নাড়া দিয়েছে। অন্তত সরকার ও প্রশাসনের সজাগ থাকলে এমন পরিস্থিতি হতো না। এখানে সরকারের গাফলতি রয়েছে। রয়েছে প্রশাসনের উদাসীনতা। নোয়াখালী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি। অনেক বড় বড় মানুষের জন্ম। তাদের সন্তানরা আজকে স্থানীয় প্রতিনিধি সেখানে এমন ঘটনা কিভাবে ঘটল আমি বুঝতে অক্ষম। যেখানে ত্যাগি আওয়ামী লীগের নেতারা রয়েছেন। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে কেন্দ্র করে আজ সেখানে আওয়ামী লীগ বিভক্ত। আপনারা বিভক্ত হন, আর অবিভক্ত থাকেন, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, আপনারা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করেন। তাহলে নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় কিভাবে?

রংপুরের পীরগঞ্জ। আমার জানামতে, খুব শান্তি প্রিয় এলাকা। এলাকায় জেলে পল্লীতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গোয়ালের পশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি। মানুষের গোলার ধান, ঘরের টিনসহ সব কিছু পুড়ে ছাই হয়েছে। আর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তালি দিচ্ছেন। প্রশাসন ঘটনা শেষ হবার পর সেখানে যাচ্ছেন। আমার জানামতে, প্রশাসনকে জানানোর পরেও তারা ঘটনার অনেক পর সেখানে উপস্থিত হয়েছে। তাহলে কি প্রশাসনের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক শক্তির সংখ্যা বেশি। গত ১৩ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু এই ১৩ বছরেও প্রশাসন অসাম্প্রদায়িক হতে পারেনি। এটা কি কল্পনা করা সম্ভব? পত্রিকায় দেখলাম অজ্ঞাত অসংখ্য মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ জন্য সরকারকে আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এতো দিনে হিন্দুদের ওপর যতগুলো হামলা হয়েছে, তার কয়টির বিচার মানুষ দেখতে পেয়েছে? হয়নি বললেই চলে। মামলা হয়। গ্রেপ্তার হয়। কয়েকদিন পর ওপরের নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হিন্দুরা বিচার পায় না। এবারও মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে। কয়দিন পর ছেড়ে দেওয়া হবে। বিচার হবে কি না আমার সন্দেহ রয়েছে। কারণ সরকারের ইচ্ছে থাকলেও প্রশাসনসহ বিচার কার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় সাম্প্রদায়িক শক্তি রয়েছে। যেখান থেকে সরকার চাইলেও বের হয়ে আসতে পারছে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাই এদেশের মানুষের আপনার প্রতি বিশ্বাসটা অনেক বেশি। দয়া করে আপনার ওপর রাখা বিশ্বাসটা ভাঙবেন না। এদেশের হিন্দুরা সব সরকারের আমলেই মার খায়। কিন্তু আপনার আমলে মার খাবে, এটা ভাবতে অবাক লাগে। আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আপনি বিশ্বনেত্রী। আপনি ইতোমধ্যে বলেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাই শাস্তি পাবে। কিন্তু শাস্তিটা দেবে কে? যাদেরকে আপনি শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তারা কি আদৌ শাস্তি দেবেন? আমার কিন্তু সন্দেহ রয়েছে। ২০০১ সালের ঘটনা সবার মনে আছে, নিশ্চয়ই। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। আমার পার্শবর্তী এলাকা আগৈলঝাড়া, গৌরনদী। সেখানে হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করা হয়েছিলো।মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো। মন্দিরে হামলা ভাংচুর করা হয়েছিলো। কিন্তু তার কতটুকু বিচার হয়েছে আজও জানি না। সেটা ছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল। ফলে এটি নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই। কারণ বিএনপির সঙ্গে ছিলো জামায়াতে ইসলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। ফলে জনগণ আশার আলো একটু বেশি দেখবেন, এটিই স্বভাবিক। কিন্তু সেই ‘গুরে যদি বালি’ হয়, এর চেয়ে দুঃখ জনক আর কি হতে পারে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার কাছে আমার আবেদন, হিন্দুদের সুরক্ষায় প্রয়োজনে নতুন আইন করুন। অন্যথায় হিন্দুরা একদিন বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কিন্তু আজকে বিলুপ্তির পথে। আশা করি আপনি টেনে উঠাবেন। না হলে ওই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আরও বেশি আপনার মাথার ওপর জেঁকে বসবে। আর যদি আপনার কিছু করার না থাকে সেটিও স্পষ্ট করুন। তাহলে হিন্দুরাই সিদ্ধান্ত নেবেন, তারা কি করবেন। কারণ যখন মাথার ওপর ছাঁদ থাকবে না। তখন তারাই মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেবেন। দয়া করে হিন্দু সম্প্রদায়কে আর কষ্ট দেবেন না। আর কত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে আপনি বলুন। যুগে যুগে হিন্দুরা মার খাবে, এটা হতে পারে না। দয়া করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনি বসে থাকবেন না। অপরাধীদের এমন শাস্তি দিন, সাম্প্রদায়িক শক্তিও যেন মনে করে হিন্দুদের গায়ে ও মন্দিরে হাত দিতে নেই। সে হাত শেখ হাসিনা ভেঙে দেন।

লেখক : সাংবাদিক