নায়িকা নুসরাত, কবি নজরুল ও ‘অন্ত:সত্তার গল্প’
—–হাসান শান্তনু
সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটিকে অভিনেত্রী নুসরাত জাহান নিশ্চয় গুগল থেকে ডাউনলোড করেননি, তাঁর গর্ভ থেকেই বাচ্চাটা পৃথিবীতে এসেছে। ওপার বাংলার সিনেমার নায়িকা নুসরাত এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেন বৃহস্পতিবার। ছেলেটির বাবা কে- এ পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। এ নিয়ে এপার বাংলার ‘পুরো পর্নো, আধা পর্নো ধারার কথিত প্রচারমাধ্যম’ যেভাবে নুসরাতকে ‘চরিত্রহীনা’ প্রমাণের চেষ্টা করছে, সেটা নি:সন্দেহে অভব্য পুরুষতন্ত্রের বর্হি:প্রকাশ। কে বিয়ের আগে, বা পরে সন্তান জন্ম দিলেন- এটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত জীবনের অংশ। এতে ধর্ম, সংস্কৃতি, সিনেমাপাড়ার মান, জাত একেবারে রসাতলে চলে যায় না।
মানবসন্তানের জন্ম দেয়া কোনোভাবেই নারীর একার পক্ষে সম্ভব নয়। সেখানে পুরুষের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনার মিল-অমিলের প্রশ্নে নয়, প্রয়াণ দিবসে সর্বস্তরের মানুষের গতকাল স্মরণ করা কবি নজরুলের জীবনের ‘অপ্রতিষ্ঠিত’ একটা দিক আলোচনায় আনা যায়। ‘বিদ্রোহী কবি’ নজরুল ও একশ্রেণির প্রচারমাধ্যমের সবশেষ ‘হটআইটেম নুসরাত’- দুজনের জন্মই পশ্চিমবঙ্গে। দশ-এগারো বছর আগে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলা একাডেমির আয়োজিত এক সভায় দেয়া প্রখ্যাত গবেষক গোলাম মুরশিদের বক্তব্য নিয়ে কেউ কেউ ফাঁও হইচই করেছিলেন। কবির বিয়ের তারিখ (২৫ এপ্রিল, ১৯২৪) আর তাঁর প্রথম ছেলের জন্মতারিখ (১৮ আগস্ট, ১৯২৪) উল্লেখ করে ওই সভায় গোলাম মুরশিদ বলেন- ‘নজরুল যখন বিয়ে করেন, তখন প্রমীলা কয়েক মাসের গর্ভবতী ছিলেন। কারণ, মাত্র তিন মাস তেইশ দিনে সন্তান হয় না।’
কবি পুরুষ হওয়ায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ওই আলোচনা হয়তো সেভাবে জোরদার হয়নি; বরং কবির পক্ষে ‘প্রতিবাদ’ হয়েছিলো। যদিও এখানে নারী চরিত্র আছেন- প্রমীলা। স্বকীয়তায় সাহিত্যে তিনি তেমন উজ্জ্বল নন বলেই হয়তো নারী হয়েও কথিত অন্ত:সত্তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। হতে পারে, নজরুল এ দেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ায় বিয়ের আগে প্রমীলার অন্ত:সত্তার মতো ‘অমীমাংসিত বিষয়ে’ আলোচনায় একটা গোষ্ঠী উৎসাহী ছিলো না।
অবশ্য এটাও সত্য- প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিকগোষ্ঠী নজরুলকে ‘মুসলমানের কবি’ অ্যাখ্যা দিয়ে তাঁর সম্পর্কে সাহিত্যগত তর্ক-বিতর্ক, গবেষণায় যে রক্ষণশীলতা দেখায়, সেগুলো মধ্যযুগীয় আদলের কাজকারবার। যে কোনো ব্যক্তি কবি, লেখকের জীবন-যাপন সাহিত্য আলোচনায় আসতে পারে, ব্যক্তিকে জানার প্রয়োজনেও। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মদ্যপ ছিলেন, বোদলেয়ারের মৃত্যু হয়েছিল সিফিলিসে ভুগে, পৃথিবীরশ্রেষ্ঠ চিত্রকর রাফায়েল মারা গিয়েছিলেন সিফিলেসে। এসব তথ্য জানাজানির পর কী তাঁদের সৃষ্টির মর্যাদা সামান্যও কমেছে?
লেখক: সাংবাদিক