বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি

জাফর ওয়াজেদ

বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি

—জাফর ওয়াজেদ

একটি পশ্চাৎপদ জাতির জীবনে সূর্যের মতো দীপ্ত হয়ে তিনি জেগে আছেন, এখনো এই বাংলায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানÑবাঙালি জাতির পিতা। জন্মেছিলেন এই বাংলার নিভৃত কোণে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারী মাস হিসাবে মার্চ অঙ্গীভূত। বসন্তের উতল হাওয়ায় চৈত্রের শুরুতেই জন্মেছিলেন টুঙ্গিপাড়ায়, বাঙালির তীর্থস্থানে। তারপর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সমন্বিত করে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। পথ যতই হোক চড়াই-উতরাই, বন্ধুরÑদুপায়ে মাড়িয়ে গেছেন। সব বাধা, প্রতিবন্ধকতার সামনে ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু কোথাও টলেননি। আপসহীন ছিলেন আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রশ্নে। পূর্বসূরি রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, সুভাষ বসু, নজরুল, দেশবন্ধু, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলার পথ ও পন্থাকে আত্মস্থ করে নিজস্ব নতুনপথ নির্মাণ করে এগিয়ে গেছেন। পথে পথে রেখে গেছেন অগ্রযাত্রার স্বাক্ষর। বিজয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ কার্ল ড্রেজার বাহাত্তরে বলেছিলেন, ‘প্রায় বারো শ বছর পর বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পরে বাংলাদেশ এমন নেতা পেয়েছে, যিনি রঙে-বর্ণে, ভাষায় এবং জাতি বিচারে প্রকৃতই একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাস থেকে তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি জাতির স্রষ্টা।’ খ্যাতনামা ব্রিটিশ সাংবাদিক সিরিল ডান উনিশ শ বাহাত্তর সালে লিখেছেন, ‘তিনি সুদর্শন, প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনলবর্ষী বক্তা এবং শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো ক্ষমতা রাখেন।’ ঘুমন্ত জাতিকে তিনি করেছিলেন ‘ইতিহাস রচনাকারী দুর্জয় বীর।’ একক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠা জাতি প্রতিরোধও গড়ে ছিল। দেশের মানুষ একটি দণ্ডে একাত্ম হয়েছিল, তারই বজ্রকণ্ঠের উদাত্ত আহ্বানে। দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম ও যুদ্ধ শেষে একটি নতুন রাষ্ট্রকে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে দিয়েছিলেন। ‘বাঙালি’ নামক একটি জাতিসত্তার নিজস্ব স্বাধীন ভূখণ্ড তৈরি করেন। সেই ভূখণ্ড ও তার অধিবাসী নিয়েই তাঁর জীবন-যৌবন, ধ্যানজ্ঞান, সাধনা ছিল। বলেছিলেনও তাই, ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাবে এই আমার জীবনের সাধনা। এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই চেষ্টা করেই মরতে পারি।’ চেষ্টা তিনি করেছিলেন আপ্রাণ। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, তিনি মৃত্যুঞ্জয়। বারে বারে তিনি ফিরে আসেন এই বাংলায়Ñকখনো কবিতায়, কখনো গানে-গল্পে, ছড়া, উপন্যাস, প্রবন্ধেই শুধু নয়, বাঙালির শিক্ষাদীক্ষাসহ প্রাত্যহিক জীবনে। বাংলার মাটি, বাংলার জলকে পুষ্ট করেছেন তিনি। আলোর সাধনাই করেছেন। নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। বাঙালির যে লালিত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তাকে লালন করেছেন নিজের জীবনে যেমন, তেমনই প্রসারিত করেছেন মানুষজনের কাছে। বাঙালির ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত লড়াই-সংগ্রাম করেছেন।

বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছেন ছাত্রজীবনেই। আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে এসে সর্বস্তরে বাংলা প্রবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার প্রশ্নে ছিলেন অটল। এই প্রশ্নে কোনো ছাড় বা আপস করেননি। বাঙালির জীবনচর্চা, তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে পবিত্র জ্ঞান করতেন। গ্রামীণ ও নাগরিক উভয় সংস্কৃতির বিকাশে বাঙালির লালিত চিরায়ত ধারাকে বিনষ্ট হতে দিতে চাননি। বাঙালিয়ানার সঙ্গে সাযুজ্য যে কোনো জিনিসকে গ্রহণ করতে চাইলেও নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির সত্তাকে অক্ষুণ্ন রেখেছেন। একটি জাতিÑআগেই যার ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছেÑসেই ভাষা ও সংস্কৃতি যখন আক্রান্ত, বিভ্রান্ত, লাঞ্ছিত, তখন তার বিরুদ্ধে অমোঘ ব্যবস্থা গ্রহণই তো স্বাভাবিক। তাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যতবারই আঘাত এসেছে, ততবারই প্রতিরোধ হয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধু, সেসব প্রতিরোধে নেতৃত্বেও দেন।

‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার ইতিহাস, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়াÑতাই নিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর সময়ে বহুবার তিনি উচ্চারণ করেছেন এই অমোঘ মন্ত্র। স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন পলিমাটিঘেরা ৫৪ হাজার বর্গমাইলের বদ্বীপের মানুষজনকে, ‘জাগো বাঙালি জাগো।’ জেগেছিল বৈকি। হাজার বছরের ঘুমন্ত জাতি তার লালিত স্বপ্নের আরাধ্য পুরুষকে পেয়েছিল তার আত্মার কাছাকাছি। যেখানে অহরহ স্পন্দিত হয়েছে বাংলার মন্ত্র। তাই অনায়াসে পুরো জাতির কণ্ঠে তুলে দিতে পেরেছিলেন সেই, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। জীবন সাধনাই ছিল যার বাংলা ও বাঙালিকে নিয়েÑআর এজন্য জেল, জুলুম, হুলিয়া, ফাঁসির কাষ্ঠ পেরিয়ে প্রাণও দিলেন। সপরিবারেই। বাঙালি জাতির একমাত্র ট্র্যাজেডির মহানায়কও তিনি। বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। যিশুখ্রিষ্টের মতো। মহাত্মাগান্ধীর মতো। ঘাতক হরণ করতে পারেনি তাঁর আত্মমর্যাদা। হরণ করতে পারেনি তাঁর বাঙালি সত্তার পূর্ণতা। যিনি রবীন্দ্রনাথের মতোই ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন। বলতে পেরেছেন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ‘আমি তোমাদেরই লোক।’ একটি জাতির মনে যিনি অনেক সূর্যের আশা নিয়ে প্রোজ্জ্বলিত, জাতিকে করেছেন আত্মসচেতন, জাতীয়তাকে দিয়েছেন ভাষা। দিয়েছেন সেøাগান: ‘জয় বাংলা’। রবীন্দ্রনাথ- নজরুলের মতো বাঙালির জয় চেয়েছেন। আর এই চাওয়াতেই থেমে থাকেননি, ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। যে জাতি একটি ধর্মান্ধ, সেনাশাসিত রাষ্ট্রে হারিয়ে ফেলেছিল নিজের আত্মা, স্বতন্ত্র সত্তাকে, নিজদেশে ছিল পরবাসী হয়ে, সেই জাতিকে ডাক দিলেন ‘জয় বাংলা’ বলে। ভূকম্পনের মতো সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠেই যেন রণিত হয়ে ওঠেছিল সেদিন গুলি-বারুদের মুখেও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। বাঙালি জাতীয়তার মূর্ত প্রতীক হয়ে জাতিকে উপহার দিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’ বাঙালির জাতীয় সংগীত। একটি জাতির আত্মশক্তির প্রতীক হয়ে তিনি বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরেছিলেন ভাষাভিত্তিক, জাতীয়তাবোধক রাষ্ট্র। যার ভাষায় তিনি জাতিসংঘে ভাষণও দিয়েছেন।

তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। কারও কাছে ছিলেন শেখ সাহেব, কারও কাছে মুজিব ভাই, কারও কাছে শেখের ব্যাটা। অর্থাৎ বাঙালি তার প্রাণের সম্পর্কে গ্রন্থিত করেছিল তাঁকে সম্বোধনের মাধ্যমে। নানা শ্রেণি, বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছেই প্রতিভাত হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিত্রাতা। নিরন্ন বুভুক্ষু মানুষ থেকে শুরু করে পাদপ্রদীপের আলোয় ভাসিত মানুষও তাঁকে কেন্দ্র করেই স্বপ্ন দেখেছে স্বাধীনতার, মুক্তির। স্বাধীনতাও পেয়েছে। কিন্তু মুক্তির পথ পাড়ি দেওয়ার আগেই বাঙালির জাগরণ, বাঙালির কণ্ঠ, বিশ্বাস, আশা-ভরসা, আস্থার একমাত্র মানবকে নির্মম নৃশংসতায় ঘাতক চক্র বিলীন করে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি তো হারিয়ে যাওয়ার, মিলিয়ে যাওয়ার, লুপ্ত হওয়ার নন। তাই যতই পথ পাড়ি দেয় বিমূঢ় জাতি, ততই তিনি উদ্ভাসিত হন। যিশুর মতো শত্রুকেও বুকে ঠাঁই দিয়েছিলেন, মার্জনা করেছিলেন। ভেবেছিলেন, তার জাতিসত্তার মানুষ, ভুল শুধরে নেবে। কিন্তু খুনিচক্র স্তম্ভিত করে দেয় একটি জাতিকে। সেই সঙ্গে তার ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। এর রেশ জাতিকে এখনো বহন করতে হয়। অবশ্য ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ভরসা ছিল তাঁর জনগণ। যে দেশবাসীকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করেছেন স্বাধিকারের পথে, স্বায়ত্তশাসনের পথে। যে জনগণকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন সর্বাত্মক ত্যাগের জন্য। তাই দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৯ জানুয়ারির ভাষ্যে: ‘তবে ভরসা হচ্ছে, দেশবাসী আজ সম্পূর্ণ সচেতন ও জাগ্রত। ষড়যন্ত্র জালকে ছিন্নভিন্ন করে কায়েমি স্বার্থবাদকে খতম করার ক্ষমতা দেশবাসী রাখে।’ তিনি পাকিস্তানি নেতাকে বলে দিয়েছিলেন একাত্তরের গোড়াতেই, ‘আমি ঘোরপ্যাঁচে বিশ্বাস করি না। আমি সোজা পথের পথিক এবং সমস্যাবলির আমি সরাসরি সমাধান চাই।’ চেয়েছিলেনও তাই। সেই সুযোগও তিনি দিয়েছিলেন। হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন শাসকগোষ্ঠীকে, ‘আগুন নিয়ে আর খেলবেন না।’ সেই সঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তাকে স্বাধীনতার জন্য, কঠিন সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে বলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জে মিশনারি স্কুলে পড়েছেন। সেই সুবাদে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাও আয়ত্তে ছিল। পারিবারিক পরিমণ্ডলে বাল্যকালে আরবি শিখেছেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেছেন অর্থ জেনেই। ইংরেজি জানা ছিল বলেই শুধু নয়, মেধাবী হওয়ার কারণেও কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি এবং বেকার হোস্টেলে সিট পাওয়া সহজসাধ্য হয়েছিল। কলকাতা এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের সঙ্গে রাজনীতিচর্চার কারণে উর্দু ভাষাও জানা ছিল ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় তিনি করাচি, লাহোরে বক্তৃতা দিলেও পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশে কখনো উর্দুতে বাতচিত করেননি। উপমহাদেশীয় বহুলপ্রচলিত ভাষা হিসাবে হিন্দিও বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। নানা ভাষা বঙ্গবন্ধুকে উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ করেছে নিজস্ব ভাষার স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যকে বহাল রাখার সংগ্রামে বলীয়ান হতে। বঙ্গবন্ধুর পাঠের তালিকায় এসব ভাষার গ্রন্থ দেখা যায়। জেলখানায় যেমন পাঠাগারে কাটাতেন, বাড়ির পাঠাগারেও তেমনই। রবীন্দ্র-নজরুল রচনাবলি বহুবারই পাঠ করতে হয়েছে দীর্ঘ সময় জেলে কাটানোর কারণে। কলকাতায় ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পরও স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছিলেন যথাসময়ে। বেকার হোস্টেলে তার প্রতিবেশী ছিলেন কবি গোলাম কুদ্দুস। সেই সুবাদে সেসময়ে অনেক লেখক, সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। স্বাধীন দেশে তিনি তাদের অনেককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সম্মানও প্রদর্শন করেছেন।

১৯৪৭ সালে দেশ যখন ভাগ হলো, তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব উপলব্ধি করলেন, এক উপনিবেশ থেকে বাঙালি আরেক উপনিবেশের অধীন হলো। কলকাতা ছেড়ে আসার আগে ঘরোয়া বৈঠকে সহকর্মী ছাত্রনেতা কয়েকজনকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন, ‘আমরা শেষ হয়ে গেছি, নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’ ঢাকায় এসে রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে পারলেন যে, বাঙালি জাতি শেষ হয়ে গেছে, ‘সেই দিনই শপথ নিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে।’ আর এর কিছুদিন পরই দেখলেন বাঙালির ভাষা ও কৃষ্টির ওপর স্বয়ং পাকিস্তানের নেতা জিন্নাহসহ শাসকগোষ্ঠীর আঘাত। থেমে থাকেননি। প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। ১৯৪৮ সালে গঠন করেন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এই সংগঠনের নেতৃত্বেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে শুরু করেন আন্দোলন। বাঙালির জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার প্রশ্নটি ছিল তীব্র। ‘রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আন্দোলন করতাম’Ñকী কঠিন অবস্থা ছিল। জনগণের ঘোর কাটানো ছিল প্রধান দায়িত্ব। ছাত্র ও সেসময় শিক্ষিত সমাজ আন্দোলনে শামিল হলেও জনগণ ছিল নির্জীব। ‘সেদিন অক্টোপাসের মতো চারদিক থেকে বাংলাকে এবং বাঙালিকে শেষ করতে ষড়যন্ত্র চলছিল।’ ঠিক সেসময়ই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদেরসহ জেলে আটক থাকা অবস্থায় সংকল্পে আরও দৃঢ় হন যে, বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে, নতুবা ব্রিটিশদের নির্মম শোষণ শেষে পাকিস্তানি প্রভুদের শোষণ ত্রাসনে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াবে। বাঙালি জাতি বলে কিছুই থাকবে না। যে জাতি কিছুদিন আগেই ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে আন্দোলন করেছে, তাদেরকে জাগিয়ে তুলতে হবে বাংলা ও বাঙালিকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল সংস্কৃতির বাহন হিসাবে ভাষা হচ্ছে জাতির সামগ্রিক ঐতিহ্যের ধারক। ভাষা নিছক ভাবপ্রকাশ মাত্রে সীমাবদ্ধ নয়, একটি জাতির সার্বিক বিকাশ-বিনিময়ের মাধ্যম। জানতেন তিনি, মাতৃভাষা দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা না পেলে সেই ভাষাভাষী মানুষের প্রাধান্য অস্বীকৃত হয়, তারা হয়ে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তার ভাষায়। রাষ্ট্র-জাতির পরিচয়ের চেয়ে অনেক গভীরে নিহিত সেই পরিচয়ের শিকড়। দেখলেন, বাংলাকে উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহার করে পশ্চিম ভূভাগকে সমৃদ্ধ করে নিচ্ছে।

বাঙালির ভাষা হিসাবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার সব আয়োজন ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব একাট্টা হয়ে জীবনমরণ লড়াইয়ে নেমেছিলেন। তিনি জাতিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলেন প্রিয় বাংলা ভাষা ও বাঙালি ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্যের দিকে। বাঙালি তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো সেসময় থেকে চিনে নিতে শুরু করে। পাকিস্তানি আর বাঙালিতে দ্বন্দ্ব ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে। কায়মনে বাঙালি হওয়ার জন্য শেখ মুজিব তাঁর জীবন সাধনা ও সংগ্রাম শুরু করেন সেই ১৯৪৮ সালেই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় যখন একদল বাঙালি ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি করেন, তখন শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতারা সেøাগান দিলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে নানাভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সংস্কৃতির একমাত্র নিয়ামক শক্তি হিসাবে সামনে তুলে ধরে ধর্মকে। বঙ্গবন্ধু দেখলেন, পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলা ও উর্দুর মিশ্রণে নতুন পাকিস্তানি ভাষা উদ্ভব, কিংবা আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলা বর্ণমালা, বানান, ব্যাকরণ প্রভৃতির সংস্কার, বাংলা ভাষা সরলীকরণ, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তন প্রভৃতি উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে এবং সেই সূত্রে বাংলা সাহিত্যকে দুর্বল ও বিকৃত, বাঙালি সংস্কৃতিকে পঙ্গু-খণ্ডিত করে এবং ওই পথ ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনাকে সমূলে উৎপাটিত করার সার্বিক অপপ্রয়াস চালায় শাসকরা। শেখ মুজিব ক্রমশ প্রতিরোধী হয়ে ওঠেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংহত করতে প্রাগ্রসর ভূমিকা রাখে। তারপরও বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি নয়া উপনিবেশবাদী শাসক শোষক চক্রের ষড়যন্ত্র বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে তারা বাঙালি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহায়তা পায়। শেখ মুজিব বুঝেছিলেন, গণতান্ত্রিক, শোষণহীন, মানবিক সমাজ বিনির্মাণে পাকিস্তান এক অনুর্বর ক্ষেত্র।

বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হলেও এই ভাষার প্রতি অবমাননা থেমে থাকেনি। পাকিস্তানি গণপরিষদেও বাংলায় ভাষণ প্রদানে নিরুৎসাহিত করা হতো। বাধ্য হয়ে ইংরেজিতে ভাষণ দিতে হতো। এমনকি সংসদের দিনের কার্যসূচিতে বাংলা ভাষা নয়, থাকত উর্দু ও ইংরেজি। গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিব সেই পঞ্চাশ দশকেই সংসদের ভেতর প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেবার সুযোগ তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের ৯ নভেম্বর করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে ফ্লোর নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্পিকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমাকে বাংলায় কথা বলতে হবে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, এ ভাষা আপনার বোধগম্য হবে না, তবুও আমাকে বাংলাতেই বলতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন শুধু নয়, তার আগে পরেও বাংলায় বক্তব্য রেখেছেন। পাকিস্তান সংসদের সরকারি ভাষা ছিল ইংরেজি, উর্দু ও বাংলা। অধিবেশনকালে সদস্যদের কাছে দিনের যে কার্যসূচি বিতরণ করা হতো তাতে বাংলা ভাষা না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৬ সালের ৭ জানুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি জানি না, বিষয়টি আপনি অবগত আছেন কি না? কিংবা এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে কি না? কিন্তু জানতে চাই, সংসদের অফিস থেকে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে এবং কেনইবা বাংলাকে বাদ দেওয়া হয়েছে?’ এসব প্রশ্ন রেখে বঙ্গবন্ধু কার্যপ্রণালি বিধির সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘যেহেতু তিনটি ভাষাই সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃত, সেহেতু তিনটি ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিতে হবে। যদি দিনের আলোচ্য কর্মসূচি ইংরেজি ও উর্দুতে করা হয়, তাহলে তা অবশ্যই বাংলাতেও করতে হবে। কেননা দিনের কার্যসূচি কার্যবিবরণীরই অংশবিশেষ।’ এভাবে তিনি সংসদে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করায় ছিলেন সক্রিয়। ১৯৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব আবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সংসদে। খসড়া শাসনতন্ত্রে ভাষার মারপ্যাঁচে বাংলা ভাষাকে কোণঠাসা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। যাতে বলা হয়, ‘একটি জাতীয় ভাষা (ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ) উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দায়িত্ব হবে ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের।’ আবার আরেক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে ‘পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সরকারি ভাষা হবে উর্দু ও বাংলা।’ বঙ্গবন্ধু এই ‘জাতীয় ভাষা’ ও ‘সরকারি বা দাপ্তরিক ভাষা’ যে পৃথক জিনিস, তা ‘চোখে আঙুল দিয়ে’ দেখিয়ে দেন। তিনি স্পষ্ট করেন দাপ্তরিক ভাষার অর্থ রাষ্ট্রভাষা নয়। দাপ্তরিক ভাষা দপ্তরের ভাষা। তিনি ‘একটি জাতীয় ভাষা’ শব্দনিচয়ের প্রতি বিশেষভাবে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘এটা কিন্তু ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছে।’ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ঘোষণা করলেন যে, সরকারি বা দাপ্তরিক ভাষা (অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ) অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রভাষা (স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ)। শেখ মুজিব এই বিষয়টি উল্লেখ করে বললেন, ‘ব্রিটিশ রাজত্বকালে ইংরেজি সরকারি ভাষাও ছিল এবং আমরা বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ব্যবহার করতাম। পূর্ব বাংলায় আমরা সরকারি বলতে রাষ্ট্রভাষাকে বোঝাই না।’ এই ‘দাপ্তরিক ভাষা’ শব্দযুগল ব্যবহারের পেছনে শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের যে দুরভিসন্ধি রয়েছে, তা সংসদেই উপস্থাপন করে বলেন, ‘যদি দুরভিসন্ধি নাও থাকে এবং তা যদি ধরেও নেওয়া হয়, তাহলেও দেখা যায় যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, উর্দু ও বাংলা হবে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা এবং খসড়া শাসনতন্ত্রে ওই মর্মে বিধানও রাখা হয়েছিল। তিনি এই ধারার ওপর সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। সংশোধনীতে শেখ মুজিব উল্লেখ করেন, ‘দুটি রাষ্ট্রভাষা যথা, বাংলা ও উর্দু উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব হবে ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের।’ শেখ মুজিব এ দুই রাষ্ট্রভাষার উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য অবিলম্বে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি তুলে বলেন, ‘পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা এবং আপনি যদি ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাহলে আমি এর ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিতেও প্রস্তুত।’ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, ভাওয়ালপুর ইত্যাদি নিয়ে তৎকালীন গঠিত এলাকায় উর্দু ছিল শিক্ষার মাধ্যম। পূর্ববাংলায় একমাত্র বাংলা ভাষাতেই জনগণ কথা বলে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু, সিন্ধু, পশতু ও পাঞ্জাবি ভাষাভাষী জনগণ। কিন্তু সেখানে, যেখানে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৫৬ ভাগ রয়েছে, তারা সবাই বাংলাভাষী, ‘তাই এসব কারণের পরিপ্রেক্ষিতে আমি বুঝতে পারি না বিতর্কটা কেন? তারা এর অবসান ঘটান না কেন? তারা বিষয়টিকে নিয়ে এত প্যাঁচানোর চেষ্টা করছেন কেন? তাদের কাজই হলো সবকিছুকে প্যাঁচিয়ে ধোঁয়াটে করে তোলা এবং জনগণকে ধোঁকা দেওয়া। সব ব্যাপারেই তাদের রয়েছে দুরভিসন্ধি এবং সবকিছুতেই তারা প্যাঁচ মারার চেষ্টা করেন, যা তারা বিগত এই আট বছর ধরে করে আসছেন এবং আমার গরিব দেশকে ধোঁকা দিয়ে আসছেন।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবটি কেন গ্রহণ করা হচ্ছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবকে জনগণের দাবি হিসাবে উল্লেখ করে এটা গ্রহণ করতে বাধ্য বলে মন্তব্য করেন। ‘এখন তারা তাদের পিঠ বাঁচানোর জন্য বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। তারা এটা করতে বাধ্য, কারণ এর পেছনে রয়েছে জনগণের শক্তি।’ সেসময়ের পাসপোর্টে বাংলা বাদ দিয়ে কেবল ইংরেজি ও উর্দু ব্যবহারের প্রতিবাদ এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলা ব্যবহারের দাবি শেখ মুজিব করেছিলেন পাকিস্তানের সংসদে সেই পঞ্চাশের দশকে। তখন এই বাংলায় জন্মগ্রহণকারী অন্য নেতারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপস, বাঙালির অধিকার বিসর্জন দেওয়ার কাজে সংশ্লিষ্ট ছিল। এসব নেতা আরবি হরফে বাংলা লেখায়। কখনো বা উর্দুকে বাঙালির ভাষা করার জন্য নানা উদ্যোগ সংসদের ভেতরে-বাইরে নেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি সংসদে শেখ মুজিব প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘ইসলামের ভাষার কথা বলা হয়। ইসলামের ভাষা কোনটি? আরবি, ফারসি, উর্দু নাকি বাংলা? মুসলমানের ভাষা কোনটি, তা ফয়সালা করবে কে?’ তিনি বাংলার পক্ষে এভাবে অটল অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান গণপরিষদে বাঙালির দাবি আদায়ের কাজ শুরু করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি দার্শনিক নই। কিংবা নই ভালো আইনজীবী। তদুপরি আমি যা বলি, তা সোজাসুজি বলি।’

বাংলা ও বাঙালির জীবনঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেই তরুণ বয়সেই স্বাধীনচেতা, দৃঢ়চেতা অবস্থান নিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে সমগ্র জাতি তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ঘোষণা হিসাবে যে ২১ দফা পেশ করা হয়, তাতে বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। ১৬নং দফায় উল্লেখ করা হয়, … বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে। ১৭ দফায় বলা হয়, বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যারা মুসলীম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহিদ হয়েছেন, তাদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হবে এবং তাদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ১৮ দফায় ছিল, একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ঘোষণা করে একে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হবে। ওই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যায়। তবে পাকিস্তানি শাসক চক্রান্ত করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। বঙ্গবন্ধু ওই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। পরে পদত্যাগ করে দলের দায়িত্ব নেন।

বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার গোড়াপত্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষা গবেষণাগার করার স্বপ্ন ছিল তাঁর। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল বাংলা একাডেমি। আজও বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকারের চিহ্ন হয়ে আছে। ১৯৫২ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এই ভবনে বসেই ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির আদেশ দিয়েছিলেন। তাই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার ১৯৫৪ সালে ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। এই বাংলা একাডেমিকে নিয়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পর্বে স্বৈরাচারী সরকারগুলো নানা ধরনের খেলা খেলেছে। বঙ্গবন্ধুর সবই জানা।

১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে বাংলার গণমানুষের বিপুল ভোটে নির্বাচিত মহানায়ক বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলা একাডেমির মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে মাত্র তিন লাখ টাকা সরকার বার্ষিক বরাদ্দ করেছে। এর জন্য কাকে দোষ দেব? যারা এসব করেছে, সে আমলারা তো এদেশেরই ছেলে। বাংলা একাডেমির ভেতরের সব কথাই আমি জানি। লোক বদল করে নতুন নতুন লোক এনে বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের যে চেষ্টা চালানো হয়েছে তাও জানি।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সব সরকারি অফিস-আদালতে ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করব না। কারণ, তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’ কথা তিনি রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর পরই অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়। ভাষার উন্নয়ন, বিকাশ, পরিভাষা তৈরির জন্য ব্যাপক উদ্যোগও নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ভাষার বিকাশে শিল্পী-সাহিত্যিকদের করণীয় তুলে ধরেছিলেন। ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজে তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতিরোধ করতে পারে না। এই মুক্ত পরিবেশে বুদ্ধিজীবীদের নিজেদের অতীত ভূমিকা ভুলে স্বজাত্যেবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসাবে গড়ে তুলুন। জনগণের জন্যই সাহিত্য। এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনির মাধ্যমে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।’ এই যে বুদ্ধিজীবীদের অতীত ভূমিকা ভুলে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনেছেন, সে বিষয়টি তিনি এর আগেই খোলাসা করেছেন। যেখানে ভাষা ও স্বাধিকার প্রশ্নে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আঁতাত করাসহ আপসকামিতার যে নিদর্শন সেসময় ঘটছিল, বঙ্গবন্ধু তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। ‘বাঙালির স্বজাত্যবোধকে টুঁটি চেপে হত্যার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বারবার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর আঘাত হেনেছে, আর তাকে প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এদেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কজন আছেন? বিবেকের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনাদের লেখনি দিয়ে বের হয়ে আসা উচিত ছিল এদেশের গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, স্বাধীনতাসংগ্রামীদের কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সন্তান সূর্যসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচেষ্টাই করা হয় নাই। তার কথা বলতে আপনারা ভয় পান। কারণ তিনি ছিলেন হিন্দু। এদের ইতিহাস লেখা এবং পাঠ করার জন্যে দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাই। একদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা যেত না। কিন্তু আজ জাতীয়তাবাদ সত্য।’ এই যে সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী, যারা বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা নয়, ইসলামি পাকিস্তান নামক অলীক ভাবাদর্শ প্রচারে নিবেদিত ছিলেন, তাদের বঙ্গবন্ধুর চেনা ছিল। বঙ্গবন্ধু উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুদ্দোহার শহিদ হওয়াসহ এদেশের অসংখ্য মায়ের নাম না জানা সন্তানদের শহিদ হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, ‘স্বৈরাচারী চক্র সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে কোনো কোনো প্রফেসরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু কই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক তো সেদিন স্বৈরাচারী কার্যকলাপের প্রতিবাদে তখন পদত্যাগ করেন নাই। তখন অধ্যাপকরা একযোগে পদত্যাগ করলে আন্দোলনে এ রক্তক্ষয়ের প্রয়োজন হতো না।’ এই অধ্যাপকদের অনেকেই স্বাধীনতাকেই পূর্বাপর বঙ্গবন্ধুবিরোধী ভূমিকায় ছিলেন নিবেদিত।

পাকিস্তান পর্বে এদেশের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ছিল যথেষ্ট। প্রায় সবার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল। সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর পরই তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তার ভাবনাকে তুলে ধরেছিলেন, যা দীর্ঘদিন তার মানসপটে লালিত ছিল। ‘শিল্পী-সাহিত্যিক এবং কবিদের জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষা অবশ্যই প্রতিফলিত করতে হবে। তারা তাদের মানুষ, তাদের মাতৃভূমি ও সংস্কৃতির জন্যে শিল্পচর্চা করবেন।’ অর্থাৎ বাঙালির শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি গণমানুষের জন্য হোকÑএই দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রবিষয়ক ইত্তেফাক গ্রুপের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘পূর্বাণীর’ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু আবেদন জানিয়েছিলেন, জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্য। তিনি তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘শিল্পী, কবি এবং সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে কোনো অন্তরায় আমার দল এবং আমি প্রতিহত করব। আজ আমাদের সংস্কৃতির সামনে কোনো চক্রান্ত নেই। শাসন বা নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল নেই। শিল্পী-সাহিত্যিকরা আর মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের জন্যে সংস্কৃতিচর্চা করবেন না। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি, কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট করেছিলেন যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেলে সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা যায় না। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না বলেই বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘যে সংস্কৃতির সাথে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই, তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।’ বঙ্গবন্ধু বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অতীতে যেসব চক্রান্ত হয়েছে, সেসব স্মরণ করিয়ে দিয়ে এসব বন্ধের কথা বলেন। ‘বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব বাঙালি সরকারি সমর্থন পেয়েছেন, তাদের দিন আজ শেষ।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশন এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর পুরো জীবন সাধনায় বাঙালির সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে চেয়েছেন যে কোনো মূল্যে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই চাইতেন মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বনে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় দেশের সংগীতশিল্পী সমাজ বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা প্রদানকালে ‘বঙ্গ সংস্কৃতির অগ্রদূত’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা ভালোবাসা এবং শান্তির অনেক গান গেয়েছেন। আজ বস্তির নিঃস্ব সর্বহারা মানুষের জন্য গান রচনার দিন এসেছে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মতো বিপ্লবী গান গাইতে হবে। মানুষের মনে প্রেরণা জোগাতে হবে, যদি এতে বাধা আসে, সেই বাধা মুক্তির জন্য সাত কোটি বাঙালি এগিয়ে আসবে।’ বাংলার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নীতি-নির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যে শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ছিল না, এ আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু সে কথা বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘জনগণ যখন অধিকার আদায়ের জন্যে সংগ্রাম করছিল, তখন একশ্রেণির শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি গত ২৩ বছর মৌলিক গণতন্ত্রের প্রশান্তি গেয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গুছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তারা কি আজ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন যে, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন? কোন ৪০ জন ব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন? কোন বিশেষ মহল তথাকথিত ইসলামের নামে নজরুলের গান ও কবিতার শব্দ বদলেছে? রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্বটা থাকে কোথায়? যে মৌলিক গণতন্ত্র ও ডিক্টেটরি শাসনের পতন ঘটানোর জন্য বাংলার বীর ছাত্রজনতা শ্রমিক বুকের রক্ত দিয়েছে, শাসকদেরই গুণকীর্তন করে, প্রবন্ধ লিখে, বেতার কথিকা প্রচার করে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ পয়সা রোজগার করেছেন।’ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের যে অংশটির কলঙ্কিত ভূমিকায় সমালোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার পর তারাই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষায় কলম ধরেছিলেন। চল্লিশ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শিল্পীসমাজের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন বাঙালির সেøাগান, ‘জয় বাংলা’। এই সেøাগানের মধ্যেই এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি যে নিহিত, তা বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন, ‘শিল্পীদের স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতিই এগিয়ে আসবে।’

বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকে বাঙালির মুক্তিসনদ হিসাবে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। এটি ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালির পাঠ্য রাজনৈতিক দলিল। যে দলিলের ভিত্তিতে বাঙালি সত্তরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলকে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফার প্রচারণার জন্য ষাটের দশকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশ করেছিলেন ‘নতুন দিন’। সম্পাদক ছিলেন নজরুলের অনুরাগী এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন সুফী লুতফর রহমান জুলফিকার। পত্রিকাটি অবশ্য দীর্ঘায়ু হয়নি। বঙ্গবন্ধু কঁচিকাচার আসর ও মুকুল ফৌজের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাঙালি গড়ে তোলার জন্য নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিলেন। ষাটের দশকে যারা কঁচিকাচার আসর করতেন, তাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

দেশের সংস্কৃতিকে জনসাধারণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সংস্কৃতিভাবুক শিক্ষিতজনেরই এই কথাটা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পূর্বাপর সময়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্ব বঙ্গবাসী হাজার বছরের বেশি এই জনপদে বসবাস করে আসছে পরাধীনতার শৃঙ্খলে দীর্ঘকাল ধরে। সেই ঘুমন্ত জাতির মধ্যে তার জাতিসত্তাবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ৭ জুন বলেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, ‘বাংলার সভ্যতা, বাঙালি জাতিÑএ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাই নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিকশিত হতে হতে বাঙালিকে একটি ভাষাভিত্তিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এনে দিয়েছে। অবশ্য রক্তপাতের বিনিময়ে। বাঙালি যে পাকিস্তানি নয়, বঙ্গবন্ধু বারবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এমনকি যখন পূর্ববঙ্গ নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়, বঙ্গবন্ধু সোচ্চার কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু এজন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতি একই জীবনের দুরকম উৎসারণ।

স্বাধীন দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আদল কী হবে, সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। ১৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সপ্তাহব্যাপী প্রথম জাতীয় বাংলা সাহিত্য সম্মেলন হয় বাংলা একাডেমিতে। মহতী সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘সাহিত্য ও শিল্পের উৎস জনগণ’ এই সত্যের স্বীকৃতিদান করে সুষ্ঠু জাতি গঠনে এবং জাতির চিন্তাচেতনা ও মননশীলতার উৎকর্ষ সাধনে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বলেছিলেন তিনি, ‘দীর্ঘকালব্যাপী নানা শোষণ এবং বঞ্চনার ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে আজ আমরা দরিদ্র, ক্ষুধার্থ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য আজ আমরা অর্থনৈতির মুক্তির সংগ্রামে এবং দেশ গড়ার কাজে লিপ্ত হয়েছি। কিন্তু সাহিত্য, সাংস্কৃতি, ঐত্যিহের দিক থেকে আমরা দরিদ্র নয়। আমাদের ভাষা দুই হাজারের বছরের গৌরবময় একটি ইতিহাস আছে। আমাদের সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ। আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মর্যাদাকে দেশ ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করব।’

বঙ্গবন্ধু সেদিন স্পষ্ট করেছিলেন বাঙালির শিল্প-সাহিত্য কী ধরনের হওয়া সংগত বলেছিলেন, ‘আমি সাহিত্যিক নয়, শিল্পী নয়, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎসুক। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনো সাহিত্য বা কোনো মহত সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে না। আমি সারা জীবন জনগণকে নিয়েই সংগ্রাম করেছি, এখনো করছি, ভবিষ্যতেও করব। যা কিছু করব, জনগণকে নিয়েই করব। সুধী বন্ধুরা, আপনাদের কাছে আবেদন, আমাদের সাহিত্য শুধু শহরের পাকা দালানেই যেন আবদ্ধ না থাকে। বাংলাদেশের গ্রাম গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের স্পন্দনও যাতে প্রতিফলিত হয়।’

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিগন্তকে এগিয়ে নিতে সোনার মানুষের কথা বলেছেন, ‘একটি সুষ্ঠু জাতি গঠনে শিল্প কৃষি যোগাযোগব্যবস্থা বা অন্যান্য সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। আমি সর্বত্র এই কথা বলি, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই, সোনার মানুষ আকাশ থেকেও পড়বে না, মাটি থেকেও গজাবে না। এই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে থেকেই সৃষ্টি করতে হবে। নবতম চিন্তাচেতনা মূল্যবোধের মাধ্যমে সেই নতুন মানুষ সৃষ্টি সম্ভব। মানবতার দক্ষ প্রকৌশলী দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী।’ এই সম্মেলনে সোনার মানুষ সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-বক্তৃতায় কাব্যভাষার প্রয়োগ মেলে। উদাহরণ হিসাবে ৭ মার্চের ভাষণের কথা বলা যায়। কিন্তু এটি কেবল ৭ মার্চের ভাষণেই নয়, তাঁর অতীতের অনেক ভাষণে কাব্যভাষা, ছন্দ, মাত্রা, অনুপ্রাসের অনুরণন মেলে। ১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের দিকে তাকালে দেখা যায় তাঁর কাব্যভাষা। ‘ভাইয়েরা আমার, পাকিস্তানের ইতিহাস, দুঃখের ইতিহাস। বাইশ বৎসর হয়ে গেল, পাকিস্তাানের সরকার এই দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না। ভাইয়েরা আমার, আজ আপনাদের সামনে বিরাট পরীক্ষা। আপনারা কী করবেন, কী করেছেন, আপনারা ‘স্বাধীন দেশের মতো’ বাস করতে চান কি চান না? …ভাইয়েরা আমার, আজ ২২ বৎসর স্বাধীনতা পেয়েছি। কি পেয়েছি আমরা? পেয়েছি হাওয়া, পেয়েছি গুলি, পেয়েছি অত্যাচার, পেয়েছি জুলুম, পেয়েছি হুংকার, পেয়েছি দুর্নীতি, পেয়েছি বুক খা খা করা আর্তনাদ। গরিব যখন কিছু দাবি করে, তাদের ওপর গুলি চালিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিক যখন দাবি করে, তাদের অত্যাচার করা হয়। মজুরি যখন দাবি করে, তাদের ওপর জুলুম করা হয়। ২২ বছরের ইতিহাস, খুনের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস মীর জাফরের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস, খুবই করুণ ইতিহাস। ইতিহাস গৃহহারা সর্বহারার আর্তনাদের ইতিহাস। আমরা সংগ্রাম করেছি। ২২ বছর কেটে গেল আমরা জীবন যৌবন ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পেলাম কী আজ আমরা। আজকে দেশের মধ্যে গ্রামে গ্রামে হাহাকার। সব পুড়ে পুড়ে দাউ দাউ হচ্ছে। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। আমার দেশের গরিব ভাইয়েরা উদরে ভাত দেয় না, গায়ে কাপড় দেয় না, ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়ে চলছে।’ এই যে ভাষণ যাতে বাংলা ও বাংলার মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার আর শোষণের কথা বলেছেন, তাতে শব্দচয়ন ও ব্যবহারে পরিমিতিবোধ, প্রয়োজনীয়তার প্রাধান্য মেলে। দুঃখের চালচিত্রের কথা বলেই তিনি থেমে থাকেননি। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের কথাও বলেছেন। যে ভাষায় যে শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন, তাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষাবোধ পরিলক্ষিত হয়। “আগুন নিয়ে খেলা করো না, তোমাদের দিন ফুরিয়ে গেছে। ষড়যন্ত্র করে, ইলেকশন বানচাল করে, একনায়কত্ব কায়েম করে গদিতে গমন করার চেষ্টা করো না। যেমন আইয়ুব খানকে গদিচ্যুত করা হয়েছে, তোমাদের তা মনে রাখা দরকার। তোমরাও মনে রেখো ষড়যন্ত্র করে দেশ শাসন করা যায় না। গুলি চালিয়ে দেশ শাসন করা যায় না। দেশ শাসন করতে হয়, ভালোবাসা-মহব্বত দিয়ে। দেশকে ভালোবাসতে হয় দেশের জন্য কাজ করে। যদি বাড়াবাড়ি করো, যদি আবার ষড়যন্ত্র করো, তাহলে লক্ষ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে এদেশের মানুষের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাইÑআমি তোমার ফাঁসিকাষ্ঠে যখন ভয় করি নাই, আমার মা-বোনরা যখন গুলি খেতে শিখেছে, আওয়ামী লীগ কর্মীরা যেহেতু গুলি খাইতে পারে, রাজপথের কর্মীরা যখন গুলি খেতে শিখেছে, শ্রমিকরা যেহেতু গুলি খেতে জানেÑপ্রস্তুত হয়ে যাও। ষড়যন্ত্র যদি করো, এর মধ্যেই করো। দরকার হয় মৃত্যুবরণ করব।…যদি কেউ ষড়যন্ত্র করে থাকেন, ভুল করেছেন। ষড়যন্ত্র আর কইরেন না, আর কইরেন না। বাধা দিব। দরকার হয়, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করব। দরকার হয় শহিদ হব, কিন্তু পাকিস্তানের গরিব-দুঃখী মানুষকে আর শোষণ করতে দেব না।” এই ভাষণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ছোটো ছোটো বাক্য। কিন্তু অর্থের দ্যোতনা অনেক বেশি। হুমকির ভাষা যখন, তখন আঞ্চলিক বা উপভাষাকে সামনে এনেছেন, যা শ্রোতা উদ্দীপ্ত বৈকিÑ‘আর কইরেন না’। এই উচ্চারণ শ্রোতাদের অন্তরে পৌঁছে যায় সহজে।

১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর বেতার-টিভিতে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ভাষণ দেন, সেখানেও তাঁর ভাষা সৌকর্য উল্লেখ করার মতো। সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে সহজ সংযোগ সাধন করার ভাষাই তিনি ব্যবহার করেছেন ভাষণে। বলেছেন, ‘২৩টি বছরের অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও শাসনে বাংলার মানুষ আজ নিঃস্ব, সর্বহারা। ক্ষুধায় তাদের অন্ন নেই, পরনে নেই বস্ত্র, সংস্থান নেই বাসস্থানের। বাংলার অতীত আজ সুপ্ত, বর্তমান অনিশ্চিত, ভবিষ্যৎ অন্ধকার।…গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ঢেলে দিয়ে আজও যারা ঘুমিয়ে আছেন, তাদেরকে এবার ডাক দিয়ে কেবল বলে যেতে চাই, জাগো, বাঙালি জাগো। তোমাদের জাগরণেই এদেশের সাত কোটি মানুষের মুক্তি।’ এই ভাষণে প্রতিটি শব্দ ও বাক্য একসূত্রে গ্রথিত। অনুপ্রাস এসেছে। বিপ্লবী চেতনা জাগাতে মানুষের মধ্যে, সহজসরল ছোটো ছোটো বাক্য ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিটি বাক্য নানা দ্যোতনা বহন করে। শ্রোতা তার বোধ দিয়ে উপলব্ধি করে নিতে পারে। কবিতার অনুরণন এখানে সহজেই মেলে। জনগণের চাহিদা ও আকাক্সক্ষাকে তাদের ভেতরে জাগিয়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ করার কাজটি এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি করেছেন।

আরও একটি ভাষণের দিকে তাকানো যায়। আবেগপূর্ণ মনে হলেও তাতে ছিল একটা জাতির আশা-আকাক্সক্ষা, আর চিন্তাচেতনার প্রতিফলন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ লোক প্রাণ হারায়। দেশে তখন সাধারণ নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকা ঘুরে এসে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত ভাষণের বাইরে যেসব বাক্য উচ্চারণ করেছেন, তার গাঁথুনি অত্যন্ত মজবুত। “আজ শপথ নিচ্ছি, বাংলার উপকূল অঞ্চলে এবার যা ঘটেছে, তা আর ঘটতে দেব না। এবারে ঐতিহাসিক বিপর্যয় সারা বিশ্বের কাছে এই মহাসত্যই তুলে ধরেছে যে, সাত কোটি বাঙালি কত অসহায়। শুধু শহরে, বন্দরে, শিক্ষিত সমাজের মধ্যে নয়, বাংলার প্রতিটি পল্লিতে, প্রতিটি অলিতে-গলিতে, দ্বীপাঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় এই মহাসত্যই আজ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছেÑআমাদের শাসনভার আমাদের হাতেই থাকতে হবে। আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তের মালিক মোক্তার আমাদেরই হতে হবে।”

স্বাধিকার আদায়ের জন্য ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তাতে আবেগপূর্ণ ভাষার আড়ালে প্রতিরোধী হওয়ার, কঠিন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। ৭ মার্চ ভাষণের পূর্ব পটভূমি এই ভাষণে মেলে। ‘প্রয়োজনে বাঙালি আরও রক্ত দেবে, জীবন দেবে; কিন্তু স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস করবে না। বাংলার মানুষ যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে; বরকত, সালাম, রফিক, শফিকরা নিজেদের জীবন দিয়ে সেই পথ দেখিয়ে গেছেন। বায়ান্ন সালে রক্তদানের পর বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তরেÑবারবার বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু আজও সেই স্বাধিকার আদায় হয়নি। আজও আমাদের স্বাধিকারের দাবি বানচাল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বাংলার ঘরে ঘরে প্রস্তুত হতে হবে। এবার চূড়ান্ত সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে আমরা গাজী হয়ে ফিরে আসতে চাই। চরম ত্যাগের এবং প্রস্তুতির বাণী নিয়ে আপনারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ুন। বাংলার প্রতিটি ঘরকে স্বাধিকারের এক একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে দেখিয়ে দিলেন; বাঙালিকে পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারও নেই।’ এই দাবিয়ে রাখা বাক্য তো মার্চের ভাষণে ‘দাবায়ে রাখবার পারবা না’ হয়ে ওঠে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের শেষে কবিতার অনুরণন মেলে, অথচ এই কবিতার অন্তরজুড়ে রয়েছে একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশিকা ও করণীয়। বললেন তিনি, ‘সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি হয়তো আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে মরতেই হয়। জানি না আবার কবে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারব। তাই আজ আমি আপনাদের এবং বাঙলার সকল মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হনÑবাংলা মানুষ যেন শোষিত না হয়। বঞ্চিত না হয়। বাঙালি যেন আর অপমান লাঞ্ছিত না হয়। দেখবেন, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। যতদিন বাংলার আকাশ-বাতাস, মাঠ-নদী থাকবে, ততদিন শহিদরা অমর হয়ে থাকবে। বীর শহিদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ দুয়ারে দুয়ারে ফরিয়াদ করে ফিরছে: বাঙালি তোমরা কাপুরুষ হইও না। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও স্বাধিকার আদায় করো, বাংলার মানুষের প্রতি আমার আহ্বানÑপ্রস্তুত হোন।’ এই ভাষণ বাঙালির জাতিসত্তার জাগরণের দরোজা খুলে দিয়েছিল। মুক্তিকামী মানুষের জন্য প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি ভাষ্য দ্রুত সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষা এবং ভাষা ব্যবহারের সৌন্দর্য ছিল গণমানুষের সহজবোধ্যতাকে ধারণ করে। ভাবীকাল যখন এই ভাষণগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে যাবেন, দেখা মেলবে, সময় এবং স্থান-কাল-পাত্রকে সামনে রেখে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মেলে ধরেছেন। একটি জাতি, তার ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর কাজটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর নিজস্ব চর্চার মধ্য দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)