বাঙালির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু
—-গাজী সারোয়ার হোসেন বাবু
গোপালগঞ্জের অজপাড়া গাঁ টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নাম তার খোকা। শিশু থেকে দুরন্ত কৈশোর। মধুমতী নদীতে সাঁতার কেটে টগবগে যুবকে পরিণত হয় খোকা। যিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ‘মুজিব ভাই’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’। তার হাত ধরেই আসে বাঙালির স্বাধীনতা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ সৃষ্টির মহানায়ক। অথচ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অন্যান্য আন্দোলন করতে গিয়ে বার বার জেল খেটেছেন। এমনকি তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়েও মারতে পারেনি পাকিস্তানিরা। বাঙালি জাতি ও বিশ্ববাসীর চাপে কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা।
তবুও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান। দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা একটি জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন অমর তিনি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ তৈরি করা হয়। যে জনগণের জন্য শেখ হাসিনা তার বাবাকে জীবন উৎসর্গ করতে দেখেছেন, সেই জনগণ তার বাবার, তাদের জাতির জনকের পুরো পরিবারসহ নির্মমতম হত্যাকান্ডের বিচার নিশ্চিতে সামান্য ভূমিকা তো দূরে থাক, বরং হত্যাকারীদের পুরষ্কৃত হতে দিয়েছে নির্দ্বিধায়, প্রবল বিস্ময়ে আর বেদনায় সেই বাস্তবতা মেনে নিয়েই ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির জনকের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেন তিনি। ওই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির সেই বাড়ির রিসেপনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম (মৃত্যু: ২৫ অগাস্ট, ২০১৬) ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা (১০(১০)৯৬) দায়ের করেন। তিন মাসের বেশি সময় ধরে তদন্তের সিআইডির সে সময়কার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তদন্তে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আগেই তারা মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
১৫ অগাস্টের পর যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়া খুনি ফারুক-রশিদ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৯৭৬ সালে যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ধারণ করা সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত অভিযোগপত্রের সঙ্গে আদালতে জমা দেওয়া হয়। সাক্ষী করা হয় ৭৪ জনকে। ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। মামলার বিচারের ২০২ কার্যদিবসে মোট ৬১ জনের সাক্ষ্য নেয় আদালত। বিচারের সব প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল (মৃত্যু: ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন তিনি। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেয়। বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী মামলাটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। তৃতীয় বেঞ্চের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এরপর ২০১০ সালে আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হলেন, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও একেএম মহিউদ্দিন। গত বছরের এপ্রিলে আবদুল মাজেদকে গ্রেফতার করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তদানীন্তন ফরিদপুর মহকুমার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
স্কুলের ছাত্রত্বকালীন বঙ্গবন্ধু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে গরীব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করা, বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরিয়ে দিতেও তিনি কার্পণ্য করতেন না। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের দায়িত্ব নেওয়ার মতো মহৎ গুণ শক্তভাবেই ধারণ করেছিলেন সেই শৈশবেই।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দেন। বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি। প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পরাধীনতার শেকল ভাঙার মন্ত্র। এর ভেতর দিয়ে তিনি আবির্ভূত হন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক হিসেবে। বঙ্গবন্ধু একাধারে জীবন সংগ্রামের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক।
শেখ মুজিবুর রহমানকে তার কাছের সবাই ডাকতেন মুজিব ভাই বলে। এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন বন্ধু, নেতাকর্মী সবার কাছে। ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবরণ করেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের এক বিশাল জনসভায় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে কিন্তু ক্ষমতা দেবে না পাকিস্তানি শাসকরা। প্রবাসীদের সহায়তায় লন্ডনে বসেই সশস্ত্র যুদ্ধের সব কৌশল ও পরিকল্পনা করেন। সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেন। নির্বাচনের পরে ঠিক তাই হলো।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বাঙালি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানালেন। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ একটানা নয় মাস চলে যুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন জাতির জনক।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি অন্তরের গভীর থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা। তিনি বাঙালি জাতির পরম শ্রদ্ধা, ভালোলাগার একমাত্র মহান নেতা। যার ধমনিতে মিশে আছে বাংলা ও বাঙালির চেতনা কারণ তার মাঝেই খুঁজে পাই আমাদের অস্তিত্বের ঠিকানা। আমরা গর্বিত আমরা বাঙালি, আমরা সেই দেশের নাগরিক যে দেশ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি মহান নেতা, একজন বিশুদ্ধ বাঙালি জাতির পিতা। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু ও তার সপরিবারে হত্যার পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের ফাঁসির রায় কার্যকরের জন্য সরকার নিকট বিনীত অনুরোধ করছি।
লেখক: গাজী সারোয়ার হোসেন বাবু
সাংগঠনিক সম্পাদক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ।