সুখে দুখে পতনে উত্থানে

সুখে দুখে পতনে উত্থানে

—জাফর ওয়াজেদ

সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার সক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন তিনি। ক্রান্তিকালের বেড়া অতিক্রম করার ক্ষেত্রে সাহসের বরাভয় কাঁধে এগিয়ে দিয়েছেন লড়াকু-সংগ্রামী মানুষদের। ছিলেন বিশ্বস্ত সাথী, ছায়াসঙ্গী স্বামীর। শুধু তাই নয়, ক্রমশ পরিণত হয়েছিলেন স্বামীর বন্ধু, পরামর্শক, সমর্থক, সহায়ক। এমন কি সন্তানদের মানবিক বোধ, পরমত, সহিষ্ণুতা, কর্মপ্রাণ এবং দেশ প্রেমে উজ্জীবিত করার ব্রতে ছিলেন নিবেদিত। একটি দেশ, একটি জাতি এবং একটি পতাকা অর্জনে সাড়ে সাতকোটি মানুষের অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পালন করেছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। হয়ে উঠেছেন মহিয়সী।

তিনি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ছিলেন দূরদর্শী। ছিলেন প্রেরণাদায়ী। বেঁচে ছিলেন মাত্র পঁতাল্লিশ বছর। বিবাহিত জীবন যার মাত্র তেত্রিশ বছর। যার মধ্যে আবার স্বামী ছিলেন প্রায় তের বছর জেলে। বিয়ে হয়েছিল মাত্র তিন বছর বয়সে। সেকালে নিজ গোষ্ঠী, পরিবারের মধ্যেই বিয়ে শাদী চল ছিল। তাই চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারটি ছিল বাংলার প্রথা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, স্ত্রী ও বিয়ের প্রসঙ্গে। “রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোট বেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়।” কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, “আব্বার বয়স যখন দশ বছর তখন তার বিয়ে হয়। আমার মায়ের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর।” উভয়ের এই সম্পর্ক অটুট ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। মরণেও ছিলেন এক সঙ্গে। পাঁচ বছর বয়সে পিতৃমাতৃহীন রেণু বেড়ে উঠেছেন শাশুড়ি বেগম সায়েরা খাতুনের কাছেই। সংসারের সকল কাজের শিক্ষা পেয়েছেন এই শাশুড়ির কাছ থেকে। আর তারই প্রতিফলন, ছিল তাঁর জীবন চর্চায় জীবন চর্চায়। নিজের জমি থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমিয়ে রাখতেন স্বামীর জন্য। নিজের জন্য সামান্য অর্থও ব্যয় করতেন না। শৈশব, কৈশোরেই দেখেছেন, স্বামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যে রাজনীতি ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণে ও অধিকার আদায়ের জন্য। এবং এই বাস্তবতার প্রতি সমর্থন রয়েছে শ্বশুর ও শাশুড়ির।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হবার পর প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হলেন শেখ মুজিব। আর তখনই তিন সন্তানসহ স্ত্রী রেণু ঢাকায় চলে আসলেন। স্বামীর সঙ্গে এই প্রথমবারের মতো সংসার পাতেন তিনি। মিন্টুরোডের সরকারি বাড়িতে মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে বসবাসের সুযোগ বেশী দিন হয়নি। পাকিস্তানী শাসকরা সে সরকার ভেঙ্গে দেয় গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিব। কিন্তু স্ত্রী সরকারি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরেযাননি। প্রবল সাহস এবং অসীম ধৈর্য নিয়ে ঢাকায় থাকার সিদ্ধান্ত নেন। যাতে কারাগারে বন্দি স্বামীকে অন্তত মাসে দু’বার দেখতে পারেন।

২৪ বছর বয়সী বেগম মুজিব স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে স্বামী যাতে অধিক মনোনিবেশ করতে পারে সে জন্য সংসারের কাজে তাঁকে তেমন জড়িত করতেন না। পুরো সংসার একাই সামলাতেন। সন্তানদের গড়ে তোলার কাজটিতেও ছিলেন সক্রিয়। পিতার ভূমিকাও তিনি পালন করেছেন। ছয় দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিব বারবার গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু বেগম মুজিব তাতে ভেঙ্গে বা মুষড়ে পড়েন নি। শাসক গোষ্ঠীর কাছে নতও হননি। এই দৃঢ়তা দেখা যায়, ১৯৬৯ সালে। আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে সকল দলকে আলোচনার জন্য আহবান করা হয়। বন্দি শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে আলোচনায় অংশ নেবার জন্য শাসকরা ব্যবস্থা নেয়। তীব্র বিরোধিতা করেন বেগম মুজিব। তার এক কথা, মামলা প্রত্যাহার করে মুক্ত মানুষ হিসেবেই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন মুজিব। কিন্তু প্যারোলে নয়। আইয়ুব খান তার এই দৃঢ়তার কাছে নত হয়েছিলেন সেদিন। বাঙালির প্রাণের দাবী ছয় দফাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকালে শেখ মুজিব যখন জেলে, তখন বেগম মুজিব নিয়মিত কারাগারে যেতেন, সন্তানদের সহ। দলীয় কর্মকান্ড সম্পর্কে স্বামীকে অবিহত করতেন।

স্ত্রী রেণুর সঙ্গে প্রায় সব বিষয়েই পরামর্শ করতে স্বামী মুজিব। স্ত্রীর সব কথাকেই গুরুত্ব দিতেন। বন্ধু, সহযোগী ছিলেন স্ত্রী। বঙ্গমাতার জীবন ও কর্ম যদি পর্যালোচনায়, মূল্যায়ন করা হয়, দেখা যায়, রাজনৈতিক চেতনাবোধ, মানবিকতা, কর্মকুশলতা, বিচুক্ষণতা সবকিছুকে ধারণ করে আছেন। এইযে স্বামী যখন জেলে, তখনও সন্তানদের গড়ে তুলেছেন সুনিপুণভাবে। সঙ্গীত, ক্রীড়ামোদী সন্তানদের আকাঙ্খা পূরণে পিছপা হননি।বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণা এবং একের পর এক বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ এবং গ্রেফতার হওয়ার সময় ছিল বাঙালির জীবনে এক উথাল পাথাল ঘটনা। টানা জেলখাটার সময়টাতে বেগম মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের সময় ছাত্র নেতাদের সহযোগিতা শুধু নয়, পরামর্শও দিতেন। ডাকসুর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ এ নিয়ে লিখেছেনও। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও তার সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল একাত্তরের আগেই।

সব ধরনের পরিস্থিতিই মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে শৈশব হতেই। ঢাকায় বসবাসকালে তিনি স্বামীর রাজনৈতিক কর্ম ও বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। রাজনীতির বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতো। তাই বঙ্গবন্ধু যখন জেলে যেতেন, সংসারের হাল ধরতে হতো তাঁকেই। পিতার ভূমিকাও পালন করেছেন একাধারে। শেখ কামাল শৈশবেই বলেছিলেন অনেকদিন পর বাবাকে দেখে, “হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি আব্বা ডাকি।” বঙ্গবন্ধুকে যখন একাত্তর পঁচিশে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের পর বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়, তার আগেই পরিবার পরিজন নিয়ে তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বেরিয়েছিলেন। আশ্রয় পাওয়া সহজ হয়নি। পাকিস্তানীরা তন্ন তন্ন করে সন্ধান চালিয়ে বেগম মুজিব ও তার সন্তানদের খুঁজে পায়। এবং ধানমন্ডির একটি বাড়িতে এনে বন্দি রাখে। তার আগেই শেখ কামাল ঢাকা ছেড়ে চলে যায় যুদ্ধের ময়দানে। বন্দিখানা থেকে পালিয়ে শেখ জামালও যুদ্ধে যোগ দেয়। বড় কন্যা তখন সন্তানসম্ভবা। এই অবস্থায়ও মুষড়ে যাননি, সাহসে বুক বেঁধে সবকিছুকে মোকাবেলা করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যরা তখনও ধানমন্ডির বন্দি শিবিরে। পরে মিত্র বাহিনীর সেনারা তাদের মুক্ত করে।

দলের নেতা-কর্মীদের নিজ হাতে রেধেও খাইয়েছেন। এমনকি মওলানা ভাসানীকে রান্না করে খাবার পাঠাতেন। গ্রামের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রাখতেন, তেমনি নেতা-কর্মী আত্মীয়-স্বজনদের সুখে দু:খে পাশে দাঁড়াতেন। অনেক কারাবন্দি দলীয় কর্মীর পরিবারকে যেমন দেখা শোনা করেছেন। তেমনি তাদের কারামুক্ত করার জন্য উদ্যোগও নিয়েছেন। গয়নাগাঁটি বিক্রি করে অর্থ দলীয় কাজে ব্যয় করেছেন। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য তিনি স্বামীর সংগ্রামে ছিলেন প্রেরণাদায়ী। স্বামীকে শাসকদের কাছে নত না হবার সাহসও যুগিয়েছেন। দূঢ়তার সঙ্গে সবকিছু মোকাবেলা করেছেন।

সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ তিনি করেছেন, স্বামী বঙ্গন্ধুকে আত্মজীবনী রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। অথচ নিজের জীবনকাহিনী লিপিবদ্ধ করেন নি অথবা করার জন্য সময় সুযোগ মেলেনি অধিক ব্যস্ততার কারণে হয়তো। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী রচনার জন্য স্ত্রীর অনুপ্রেরণার কথা উল্লেখ করেছেন, “আমার সহর্ধর্মিনী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনী।” স্ত্রী তাকে কয়েকটি খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। “জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেল গেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।” আর বাঙালি জাতি পেয়েছে এক মহামূল্যবান গ্রন্থ। যে গ্রন্থে বাঙালি পায় তার মহানায়কের উত্থানপর্ব। মহিসীকে দেখা গেছে, সাতই মার্চ একাত্তরে, জাতির ভাগ্য নির্ধারণের সময়কালে। ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বমুহূর্তে তিনি স্বামীকে বলেছিলেন, “তোমার মনে যা আছে, তাই বলবে। তোমার কথা হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তুমি যা বলতে চাও, নিজের মন থেকে বলো।” অলি আহাদের মতো কট্টর মুজিব বিরোধী ব্যক্তিও উল্লেখ করেছেন, “অনেক ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে তাঁকে পরামর্শদাতা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে।” বঙ্গবন্ধুর সুখ দুঃখের সাথী ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্বামীর আদর্শের আলোকে মশাল ও অনেকটাই বহন করেছেন। স্বামী ও সন্তানদের সাহস, মনোবল, প্রেরণা ও শক্তি যোগানোর কাজটি যেমন সুচারুরূপে করেছেন, তেমিন,স্বাধিকার আর স্বাধীনতার পথে ছিলেন সহায়ক শক্তি। জীবনের সকল সংকটকে মোকাবেলা করে একজন নিরহংকার, ত্যাগী, কষ্টসহিষ্ণু, নিলোর্ভ, দৃঢ়চেতা, প্রত্যয়ী ও অনুকরণীয় নেত্রী হিসেবে নিজস্ব সত্বাকে তুলে ধরতে পেরেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালির সহধর্মিনী হিসেবে। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হয়ে ওঠার নেপথ্য শক্তি ছিলেন বঙ্গমাতা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কালোরাতে তাঁকেও নির্মমভাবে নিহত হতে হয় স্বামী, দেবর, তিনপুত্র, দুই পুত্রবধূসহ। স্বজন হারানোর পৃথিবীতে শুধু বেঁচে রয়েছেন দু’কন্যা। বঙ্গমাতা তিনি হয়ে উঠেছেন পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনের পরিক্রমায়। বাঙালি জাতির উত্থান ও বিকাশের অন্তরালে থাকা মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব চিরঞ্জীব ও ভাস্বর হয়ে থাকবেন এই বাংলাদেশে। যতো দিন যাবে ততোই প্রাতঃস্বরণীয় হয়ে উঠবেন তিনি।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব কীভাবে মূল্যায়িত হবেন? তিনি কী কেবলি পতিপরায়ন স্ত্রী এবং রাজনীতিক তথা জাতির পিতার সহধর্মিনী ইতিহাসের খেরো খাতায় তিনি এসবকে ছাড়িয়ে আরো দূর প্রসারিত করেছিলেন নিজেকে। ত্যাগ, তিতিক্ষা, আদর্শ, সততা, নিষ্ঠা, কর্মকূশলতায় প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে অতিক্রম করে মহিয়সীতে প্রভিভাত হয়েছেন।

লেখক: কবি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
এস/এ