২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে কী কাশ্মীরে পরিবর্তন হয়েছে?

২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে কী কাশ্মীরে পরিবর্তন হয়েছে?

—জাবেদ বেগ

আজ ভারতের পুর্বেকার প্রদেশ জম্মু ও কাশ্মিরের অভূতপুর্ব সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের দ্বিতীয়বার্ষিকী। ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭০ ও ৩৫এ রহিত করা হলে জম্মু কাশ্মীর সাংবিধানিক প্রদেশের মার্যাদা হারিয়ে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয় এবং পুর্বের প্রদেশ জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে আলাদা করা। অবশ্যই সবার মনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল এই উদ্যোগ কী কাশ্মীর ও এর জনগণের ভালোর জন্য অথবা খারাপের জন্য কোন পরিবর্তন এনেছে?

শুরুতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাশ্মীর বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে, এই পরিবর্তনের ফলে বিরামহীন মৃত্যু, সহিংসতা, পাথর নিক্ষেপ, অবরোধ, রক্তপাত এবং প্রতিরোধের একটা চক্র কাশ্মীর উপত্যকাটিকে আবারও মাসাধিককালের জন্য গ্রাস করে ফেলবে, সর্বশেষ ২০১৬ সালে বুরহান ওয়ানিকে হত্যার পর যেমন হয়েছিল।

অধিকন্তু, ধারনা করা হয়েছিল যে, এর ফলে কাশ্মীরিরা উপতক্যায় রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক কার্যক্রমকে বর্জন ও অসহযোগিতা করবে, যার ক্ষমতা ভারতের সংবিধান ও পার্লামেন্ট দিয়েছে।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এগুলোর কোনটাই ঘটেনি। গত দুই বছরে কোন আকাশ ভেঙে পড়েনি। সুতরাং কাশ্মীরীরা কি খুশীমনে ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ৩৩৫ ও ৩৫ এ রোহিতকরন মেনে নিয়েছে ও গ্রহণ করেছে? লিখে এমন জটিল ও স্তরভিত্তিক প্রশ্নের সত্যিই উত্তর দেয়া যাবে না।

কিন্তু একজন গত দুই বছরে কাশ্মীর উপত্যকায় উদ্ভুত সাধারন সামাজিক অবস্থা চিত্রিত করতে পারেন এবং জনগণকেই তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে দিন।

একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যা ভারতের সংবিধানের আর্টিকেল ৩৩৫ ও ৩৫ এ রোহিতকরনের পর কাশ্মীর উপত্যকায় এসেছে তা হল পুর্বে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক অবস্থায় থাকা জাতি ও সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ক্ষমতায়নের সাধারণ বোধের উদ্ভব, যা কিছুটা হলেও ব্যাখ্যা দেয় কেন কাশ্মীর উপত্যকার লোকজন আগে সঠিকভাবে ব্যবহার বা আচরণ করত না, যে অবস্থা কাশ্মীরের সহিংসতার অতীতের সাথে মিলে যায়।

বোঝার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, একটি ছোট্ট উচ্চবিত্তের এলিট গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ পন্ডিত থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম পরিবার, কাশ্মীরী সৈয়দ ও মোল্লা মুসলিম, শ্রীনগর শহর ভিত্তিক ধনী কাশ্মীরী হিন্দু পন্ডিত এবং কাশ্মীরী শিখদের ভুমি মালিক অংশ ঐতিয্যগতভাবে কাশ্মীর উপত্যকার সকল স্তরের ক্ষমতা বৈষম্যমূলকভাবে জবরদখল করে রেখেছে।

স্বাধীনতার পর থেকে কাশ্মীরের না কাশ্মীরের মধ্যবিত্ত শ্রেণী না নিম্নবিত্ত শ্রেণী কখনও জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ শাসন করেছে। কাশ্মীরের দলিত মুসলিম যেমন ওয়াতাল, এমনকি মধ্যমশ্রেণীর কাশ্মীরী মুসলিম জাতি যেমন লোনস, ওয়ানিস, খান্দে ইত্যাদির কথা ভুলে যান। এদের কেউই কখনও জম্মু কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সাহস করতে পারে না।

কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি ঢেউ বয়ে যাচ্ছে যেখানে অসংখ্য দরিদ্র তরুণ ও বয়স্ক, মধ্যমস্তরের সম্প্রদায় থেকে আসা পুরুষ ও নারীরা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে অনুভব করতে পারছেন, কাশ্মীর উপত্যকার দলিত ও ওবিসি মুসলমান, পাহাড়ি মুসলিম এবং গুজ্জার ও বাকারওয়ালসহ প্রান্তিক সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীসমূহের মানুষকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক চিত্রে অংশগ্রহণ করতে প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা বা উৎসাহের কারনেই তারা এমনটি অনুভব করছেন।

ফলস্বরুপ, জম্মু-কাশ্মীরের নতুন অনুষ্ঠিত ডিডিসি নির্বাচন বর্জনের পরিবর্তে বিপুল সংখ্যক কাশ্মীরী এই নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করে যা প্রথমবারের মত জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধি নির্বাচন করে।

ডিডিসি নির্বাচনের সফলতার প্রধান কারণ হল এই নির্বাচনে নন-এলিট শ্রেণী অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিল। মধ্যম স্তরের অথবা পাসমান্দা মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর বিশাল সংখ্যক ক্যান্ডিডেট বা প্রতিযোগী নির্বাচনে অংশ নেন, ২০১৯ সালের আগে যাদের এত বিশাল সংখ্যায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ছিল কল্পনাতীত। এইসব জাতিগোষ্ঠীর নতুন করে জেগে ওঠা তাদের মূল ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাসমূহে জড়িত হতে ব্যাপকভাবে আগ্রহী করে তুলেছে।

২০১৯ সাল থেজে কাশ্মীরী মরসলমানরা, যারা পূর্বে মূল ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অনাগ্রহী ছিল, এখন মূল ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতি সক্রিয়ভাবে আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং এমনকি তারা এগুলোতে অংশও নিচ্ছে, সেটা দিল্লির সিএএ আন্দোলনই হোক অথবা ভারতের সব অংশের কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ওষুধের অনুরোধই হোক।

মূল ভারতের রাজনীতির বিষয়ে এই নতুন উঠে আসা আগ্রহ কাশ্মীর উপত্যকায় কাশ্মীরীদের নিজেদের রাজনৈতিক বাস্ততা সম্পর্কে ভারতের রাজনৈতিক মতামতের স্পষ্টতা বা স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। কাশ্মীরের জনগণ এখন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে কেন যুগ যুগ ধরে কিছু সংখ্যক উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ থেকে ধর্মান্তরিত পরিবার এবং সৈয়দ মোল্লারা শুধুমাত্র কাশ্মীরের শীর্ষ পদগুলো দখল করেই রাখেনি, বরং তারা কাশ্মীর উপত্যকার প্রশাসনিক ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

২০১৯ সালের পর কাশ্মীরের জনগণ এখন ভালোর জন্য রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করেছে এবং এটা এতোদিন মূল ভারতের সাথে মিলে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারনও ব্যাখ্যা করে। কাশ্মীরের মুসলমানরা এখন ভারতের প্রধান প্রধান শহরের সাংবাদিকতা, ওষুধ, আইন, সিনেমা, টিভি ইন্ডাস্ট্রির মুখোমুখি হচ্ছে, গত দুই বছরে এই প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হয়েছে।

এই জাতিগোষ্ঠীগত দাবি এমন কিছু যা কিছু সংখ্যক উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কাশ্মীরী মুসলিম যখন মূলধারার নেতৃত্ব দিত তখন এটা উপস্থিত ছিল না, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও উগ্রবাদী কার্যক্রম মধ্যমস্তর ও নি¤œবর্গের মুসলিম শ্রেণীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকায় দ্বিতীয় ও প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছিল।

২০১৯ এর পর এটা শুধু কাশ্মীর উপত্যকায়ই পরিবর্তন হয়নি, জম্মু অঞ্চলেও হয়েছে, যেখানে দলিত হিন্দু, পাহাড়ি মুসলমান এবং গুজ্জার ও বাকারওয়াল সম্প্রদায়গুলোও তাদের নিজস্ব জাতি বা শ্রেণীগত দাবি তুলেছে, যা জম্মু ডিডিসি নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে জম্মুর হিন্দু ও মুসলিম দোগ্রা জনগোষ্ঠীর প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলো উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলিম নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক শ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ করেছে, হিন্দু ব্রাহ্মণ ও বেনিয়া এবং রাজপুত মুসলিম ও রাজপুত এবং ঠাকুর হিন্দু মিলে উচ্চবিত্ত শ্রেণী গঠিত।

২০১৯ পরবর্তী এই বিশাল পরিবর্তন এমন পন্থায় এসেছে যে জম্মু অঞ্চল ও কাশ্মীর উপত্যকার প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের রাজনৈতিক শক্তি দেখাতে পারছে, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলিম এলিটের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের কারণে আগে যা তারা দেখাতে পারেনি।

পুরাতন কাশ্মীরের মত নতুন কাশ্মীর একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা আর কোন সুবিধাবাদী গ্রুপ বা গোষ্ঠীকে দেবে না। ২০১৯ পরবর্তীতে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের রাজনৈতিক আকাঙ্খার গণতন্ত্রায়ণই সবচেয়ে বড় সফলতার গল্প হিসেবে থাকবে।

লেখক: একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক। মধ্য কাশ্মীরের বুধগাম জেলার বীওয়াহ থেকে তিনি ডিডিসি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি বিশিষ্ট লেখক ও বিখ্যাত পাবলিক স্পিকার।
এস/এ