আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস ২০২১ : আসুন বাঘ সংরক্ষণে সরকারের সহযোগী হই
—দীপংকর বর
মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃক্ষ ও বন-বনানি থাকা অত্যাবশ্যক। উপকূলীয় বন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাসহ বিপর্যয়কর ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেয়। সুন্দরবন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে।
অন্যদিকে, ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ আমাদের সুন্দরবনের রক্ষক। হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা অভিজাত প্রজাতির এ বাঘের উপস্থিতির কারণেই সুন্দরবন এত বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয়। সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগার না থাকলে সেখানকার সামগ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সুন্দরবনকে বাঁচাতে বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া প্রভৃতি পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখন বাঘের অস্তিত্ব আছে। বাঘ বাঁচাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঘ সমৃদ্ধ দেশগুলোর সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এর ধারাবাহিকতায়, ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ সমৃদ্ধ বর্ণিত ১৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে গতিশীল করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা এবং এর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ও ভয় দূরীকরণ সর্বোপরি বাঘ সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে এ দিবস পালন করা হয়। ‘বাঘ বাঁচায় সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচায় লক্ষ জীবন’ প্রতিপাদ্যে যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলাদেশে ২৯ জুলাই বাঘ দিবস ২০২১ পালন করা হবে।
বাঘের বসবাস উপযোগী নিরাপদ বনাঞ্চল ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস, চোরাশিকারিদের কারবার, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব, বাঘ ও মানুষের দ্বন্দ্ব, বনের অভ্যন্তরে অবাধে নৌ চলাচল, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বনের পাশে শিল্পকারখানা স্থাপন, বিভিন্ন ধরনের রোগ, বনে পর্যটকদের আনাগোনা, বাঘ শিকারিদের শাস্তির অভাব ইত্যাদি কারণে বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রকৃতিতে বিদ্যমান বন্য বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৯০০ টি। বাঘ বিশেষজ্ঞগণের মতে, বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার এই প্রবণতা চলমান থাকলে আগামী কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বাঘের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার জন্য আবাসস্থলের উন্নয়ন ও নিয়মিত টহল প্রদান করে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য যথোপোযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উভয় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, বাঘ ও শিকারি প্রাণী পাচার বন্ধ, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালে একটি সমঝোতা স্মারক এবং একটি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসের ১৪-১৬ তারিখ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২য় স্টকটেকিং সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার রোধে ২০১৬ সালের ২৬-২৭ অক্টোবর ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার এর আয়োজনে ‘সাউথ এশিয়ান ওয়াইল্ডলাইফ এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক’ এর ৩য় বার্ষিক সভায় অনুষ্ঠিত হয়। বাঘ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ টাইগার একশন প্ল্যান ২০১৮-২০২৭ প্রণয়ন করা হয়েছে।
বাঘ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ ও বংশবিস্তারের লক্ষ্যে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বনদস্যুর সাথে সংগ্রাম করে সুন্দরবন ও এর বাঘ রক্ষায় কাজ করে যাওয়া মাঠ পর্যায়ের বনকর্মীদের কাজে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে সরকার ৩০% ঝুঁকিভাতা প্রদান করছে। সুন্দরবন ও বাঘ সংরক্ষণের জন্য সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জে জিপিএস এর সাহায্যে নিয়মিত স্মার্ট পেট্রলিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সুন্দরবনের মধ্যে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার প্রতিরোধে বন বিভাগের সাথে পুলিশ, র্যাব, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
মানুষ-বাঘ দ্বন্দ্ব নিরসনে ২০০৮ সালে সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামে ৪৯ টি ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে। এর ফলে লোকালয়ে বাঘ আসা মাত্র খবরাখবর আদান-প্রদান ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। ২০১০ সালে ‘কমিউনিটি পেট্রল টিম’ ও ‘কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করা হয় এবং এই দলগুলোর সমন্বয়ে নিয়মিতভাবে পেট্রলিং ও তথ্য আদান-প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সুন্দরবন ও বাঘ সংরক্ষণের জন্য বন অধিদপ্তর এর কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এ বিষয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে।
মানুষ ও বাঘ দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত জানমালের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা, ২০২১ এর অধীন বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকা এবং গুরুতর আহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা করা হয়েছে।
এছাড়া বাঘের আক্রমণে নিহত ও গুরুতর আহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য “বন্যপ্রাণীর আক্রমণে জানমালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা-২০১০” এবং পরবর্তীতে প্রণীত “বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত জানমালের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা, ২০২১” অনুসারে ২০১১ সাল থেকে জুন, ২০২১ সময়কাল পর্যন্ত ৬২টি পরিবারের মধ্যে ৫৮ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে।
বাঘ হত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে অধিকতর শাস্তির বিধান রেখে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ধারা-৩৬ তে বাঘ হত্যার জন্য সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দণ্ডিত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উক্ত আইনের ধারা-৩৬ অনুযায়ী বাঘ হত্যা জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
বাঘ সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ আবাস স্থল ও পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সুন্দরবন ও এ বনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন পাঁচ বছর মেয়াদি “সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প” শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পে সুন্দরবন এবং এই বনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম, ইকোলজিক্যাল মনিটরিং ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
চলতি বছর ৩ মার্চ সুন্দরবনে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বন অধিদপ্তরের নিকট চারটি ড্রোন হস্তান্তর করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই বন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ড্রোন পরিচালনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৪-১৫ সালে বন অধিদপ্তর কর্তৃক ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬টি বাঘের সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ২০১৭-১৮ সালে বন অধিদপ্তর কর্তৃক ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১১৪ টি বাঘের সন্ধান পাওয়া যায়।
অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে সরকারের বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগের কারণে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৮ শতাংশ বেড়েছে।
সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের জন্য “বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প” নামক একটি প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে বয়স ও লিঙ্গ অনুপাতে সুন্দরবনের কম বাঘসম্পন্ন এলাকায় বাঘ স্থানান্তর, ক্যামেরা ট্র্যাপিং এর মাধ্যমে বাঘ জরিপ, সুন্দরবনে বাঘের প্রধান খাবার হরিণ এবং বন্য শূকর জরিপ, বাঘের আপেক্ষিক ঘনত্ব নির্ধারণ, সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় নাইলনের রশির বেষ্টনী তৈরি, ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহ পরিবীক্ষণ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ইত্যাদি নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে বাঘ সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। বাঘ বাঁচাতে ও বাড়াতে তার বাসস্থান, খাবার ও বাইরের শিকারিদের কবল থেকে মুক্ত করতে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় তথা বন অধিদপ্তরের একার পক্ষে বাঘ হত্যা ও চোরাচালান বন্ধ করা কষ্টসাধ্য।
আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এ বিপন্ন প্রাণীটি আমাদের দেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে। তাই আসুন, আমরা নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সুন্দরবনের রক্ষক বাঘকে বাঁচাতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হই।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়
এস/এ