পেশা যখন বিড়ম্বনা (জার্নালিজম)

পেশা যখন বিড়ম্বনা (জার্নালিজম)

— রফিকুল ইসলাম (এহ্সান)

পেশা আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। তার সঙ্গে আমাদের ‘গিভ এন্ড টেক’ সম্পর্ক। আমরা তাকে সময়, শ্রম ও মেধা দেই_ বিনিময়ে সে আমাদেরকে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ সব ধরণের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা বিধান করে। কেউ স্বীকার করুক বা নাই মানুক, পেশার স্থান ও অবস্থান পবিত্র এবং অনেক ওপরে। সার্বিক বিবেচনায় সকল নৈতিক পেশা বৈধ হলেও সবগুলি আবার মহৎ নয়।

সমাজে মহৎ পেশার সংখ্যা মাত্র গোটা তিনেক। সেগুলো হলো_সাংবাদিকতা, ডাক্তারী এবং শিক্ষকতা। এই তিন পেশার মধ্যে সাংবাদিকতা আবার সবার সেরা ও ওপরে। কেন? কারণ সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পন আর সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। সাংবাদিকরা ইতিহাসের নির্মাতাও বটে।

ইতিহাস সন্নিবেশিত হয় গণমাধ্যমের দেয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই। জাতি যদি অসময়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায়_তাহলে তাদেরকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব সাংবাদিকদেরকেই পালন করতে হয়। সবমিলিয়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে রয়েছে মিডিয়া কর্মীদের।

মস্তিষ্ককে মানব দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অর্গান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদি আপনার মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে বা বিবেক নষ্ট হয়, তাহলে বিয়ে-স্বাদী, ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা অন্যকোন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কারবার বা লেনদেন আপনার সাথে কেউ করতে চাইবে না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওটা ঠিক আছে আপনার। অথচ একটা হাত, পা বা চোখ না থাকলেও আপনি দিব্বি চলতে পারবেন। সমাজ আপনাকে ফেলে দেবে না।

আমাদের সমাজের প্রায় সব পেশাই কমবেশী বিতর্কিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে সাংবাদিক, পুলিশ ও উকিলদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুলের পরিমাণটা একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছেন_ ডাক্তার, শিক্ষক ও ব্যবসায়ীরা। তুলনামূলক বেটার অবস্থানে দেখা যাচ্ছে প্রকৌশলীদের। তাদের বিরুদ্ধে কথা তুলনামূলক অনেক কম।

সাংবাদিক এবং পুলিশদের সমালোচনায় ইদানিং সমাজকে বেশি সময় নষ্ট করতে দেখা যায়। সমালোচনাকারি নাগরিকরা বলে থাকেন, ‌‌‌‌‘‘শুধু সাংবাদিকরা পরিচ্ছন্নভাবে চলতে পারলে সমাজ অনেকটাই এগিয়ে যেত। তাদের যুক্তি হচ্ছে_ কোথায়, কী, কেন, এবং কীভাবে হচ্ছে_তা মিডিয়ার অজানা নয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অসংগতি অনুসন্ধানের দায়িত্বও তাদের।

তাই সাংবাদিকদের জীবনে স্বচ্ছতা-পরিচ্ছন্নতা খুবই জরুরী। সমাজের অন্যান্য পেশাজীবীরা অনিয়ম করলে তখন সাংবাদিকরাই শেষ ভরসা। কিন্তু সেই মিডিয়াই যদি রাষ্ট্র ও সমাজ বিরোধীদের সাথে আপোষ করে ফেলে_তাহলে আর থাকে কী?’’

আমাদের সাংবাদিকদের মনে রাখা উচিত_এ পেশার দায়বদ্ধতা অন্যান্য পেশাজীবীদের থেকে বহুগুণ বেশী। আমাদের লেখা আইন-আদালতসহ সমাজে এভিডেন্স হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যদি তাই-ই হয়_তাহলে নিজকে স্বচ্ছ রেখে লেখা দরকার। নিজে ঠিক থেকে লিখলে_কমিউনিটির মুখটা ছোট হয় না।

সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশায় প্রবেশের আগে সেটার ওজন, গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা নেয়া অনেকখানি জরুরী। আপনি যদি পেশার মর্যাদা মেইনটেইন করতে না পারেন_তাহলে আপনার পেশা সমাজে সম্মান হারাবে। আর এতে আপনি হেয় হয়ে পড়বেন। বর্তমান পরিস্থিতি যার জ্বলন্ত প্রমাণ। পেশার মর্যাদা ধরে না রাখতে পারলে আপনার প্রজন্ম ও সহযোদ্ধাদের জন্য সেটা রীতিমতো বিড়ম্বনার কারণ হবে।

এতে কোন ভুল নাই। যেটি চলমান সময়ে দেখা যাচেছ। পরিস্থিতি যদি এমনই হয় তাহলে_সন্তানরা আফসোস করে হয়তো একদিন বলে বসতে পারে_‘‘বাবা কেন যে, এমন প্রফেশনটি বেঁছে নিয়েছিলেন! আমরা সমাজে মোটেও সম্মান পাই না। কেউ মন থেকে আমাদের সাথে মিশতে চায় না।’’

আমরা পেশাজীবীরা কেউ কেউ নিজের অজান্তেই হরহামেশা নিজের পেশার সম্মান-মর্যাদা ও অবস্থানকে স্বপ্লমূল্যে বেঁচে দেই। তখন আমাদের প্রফেশনটি বিব্রত, লজ্জিত ও কলংকিত হয়। এমন ঘটনা পরিমাণে বেশী হলে_তখন সমাজে এর ‘ব্যাড ইমপ্যাক্ট’ বা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। বর্তমানে যেমন পড়ছে।

সাংবাদিকতার মতো অসাধারণ ও মহৎ পেশাটির অবস্থা আগে এমন ছিলো না। বিতর্কিত ব্যক্তি সমাজ বদলের কথা বললে, কেউই তা শোনে না। তা তিনি যেই পেশার, যতো বড়ো ক্ষমতাধর/জ্ঞানী লোকই হোন না কেন। ‌‌‌‌এ কথা মিথ্যা নয় যে, আমাদের এ পেশাতে এখনো ভালোর সংখ্যা বেশি হলেও_খারাপরা সাংঘাতিক ইউনাইটেড। তারা কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে_নিজ স্বার্থের জন্য খুটে খুটে পেশাটির শিকড় কেটে দিচ্ছে। আর এতে কমিউনিটি নামক বৃক্ষটি দিন দিন ঢলে পড়ছে।

এভাবে চলতে থাকলে অর্থাৎ খারাপদের না থামালে গাছটি এক সময় মাটির উপর আছড়ে পড়বে। তখন আর কিছু করার থাকবে না। এখনো সময় আছে বলে আমি মনে করি। খারাপ ও নষ্টদের থামাতে_ ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রচেষ্টা যে একদম কম, তা বলাটা মোটেও ঠিক হবে না।

ভিতর থেকে আমি এদেরকে গঠনমূলকভাবে সাইজ করার ধান্দায় রয়েছি। কাজ হলেও হতে পারে! আশাকরি, ডোজটা ঠিকমতো দিতে পারলেই কাম হয়ে যেতেও পারে ইনশাল্লাহ তা’য়ালা।

আমাদের সমাজে সাধ্যমতো প্রতিবাদ না করে_ভালোরা সব দেখেও চুপচাপ থাকে। এটিও একরকমের মিনমিনে বদমায়েশি। যা বড়ো ধরণের অন্যায়। এভাবেই একটি সমাজ শেষ হয়ে যায়। যেমন আমাদের সমাজ শেষ হয়ে গেছে। নিশ্চুপকারিরাও সমান অপরাধি।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো_সবাই যার যার অবস্থান থেকে (একটু সাহস নিয়ে) সত্যটা উচ্চারণ করা। শুধুমাত্র এই ওষুধটি প্রয়োগ করলেই_অপরাধি সহযোদ্ধারা ৫০% থেকে ৭০% দুর্বল হয়ে পড়বে। এটা আমার বদ্ধমূল ধারণা।

সত্য উচ্চারণের দায়িত্ব সবার আগে সাংবাদিকদের। পেশাজীবীদের কখনোই পেশাদারিত্বে ছাড় দিতে নেই। সত্য এড়িয়ে চললে আস্তে আস্তে সেই কমিউনিটি ও সমাজ দুটোই ধসে যায়। পেশাদারিত্বে আপোষ করায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম তার অবস্থান ও ঐতিহ্য দুটোই হারিয়ে ফেলেছে।

পেশার ওপর পরিষ্কার ধারণা না থাকায়_বুঝে বা না বুঝে নিজের অজান্তেই আমরা পরবর্তী প্রজন্মের মানসিক গতিকে বাঁধাগ্রস্থ করি। মূল্যবোধকে ঠিক রেখে পিতা-মাতা হয়ে আমি যদি তার প্যাশন বা ভাবাবেগকে পূর্ণ মাত্রা দিতে পারতাম, তাহলে হয়ত সে সমাজের জন্য খুব ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতো। আমার অপরিচ্ছন্ন আয়-ইনকামের দুষণ যে তার জীবনের (আত্মিক) গতিকে থামিয়ে দেয়_নানান সীমাবদ্ধতায় আমি সেটা বুঝতেও পারি না।

অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে সত্যকে এড়িয়ে গেলে সে সমাজ টেকে না। এজন্য সবারই উচিত সর্বাবস্থায় অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ানো। যা আমরা করতে পারি না বলেই_এ সোসাইটির হাল এমন করুণ। সত্য উচ্চারণই হলো ধর্মের আসল মেসেজ। শুধু মসজিদ, মন্দির গীর্জা ও প্যাগোডায় দৌঁড়ানো ধর্ম নয়। শাস্ত্রীয় মতে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধই হলো প্রকৃত ধর্ম। এটি ব্যতিরেকে ধর্ম-কর্ম অসার।

বিবেক ঠিকতো সমগ্র মানবদেহই ঠিক। সেটায় পঁচন লেগেছেতো গোটা সমাজ ডাষ্টবিন। ধর্মীয় শ্রদ্ধা, দেশাত্মবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চা না থাকলে_রাষ্ট্র ও সমাজে ধীরে ধীরে বিপর্যয় নেমে আসে। একেই বলে ‘সোস্যাল ড্যামেজ’।

আমাদের অনেকেরই ধারণা শুধু প্রাণীদেহই মারা যায়। কিন্তু না, রাষ্ট্রও মরে। তারও রয়েছে সুস্থ্যতা এবং অসুস্থ্যতা। রাষ্ট্রেরও আছে হার্ট, লিভার, কিডনী, ফুসফুস, প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয়, পরিপাকতন্ত্র ও রক্তসহ অন্যান্য অর্গান। অতীতে এই পৃথিবীতে রোগব্যাধিতে অনেক রাষ্ট্রই ইন্তেকাল ফরমাইছে। রাষ্ট্রের অর্গানগুলোর যেকোনটি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

যেমন- আমাদের দেশ একইসাথে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, হার্ট ব্লকেজ, যক্ষা, ডায়বেটিস, কিডনী ড্যামেজ ও উচ্চরক্তচাপসহ জটিল সব বিমারীতে আক্রান্ত। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির বর্তমান অবস্থাকে ‘কোমা’ বা অন্তিম বলা যায়। এক বা দুই যুগে এটি এমন পর্যায়ে আসেনি। দেশটির উপরে ফিটফাট হলেও এর ভিতরে একদমই কিচ্ছু নেই।

বলে রাখা ভালো যে, যে সমাজে নীতি ও মূল্যবোধের চর্চা থাকে না, ওটাকে আমি কোন সমাজই বলি না। বিকজ_‘এন্ড অব দ্য’ আমাদের পরিচয় মানুষ। পশুদের বিষয় ভিন্ন। নিকৃষ্ট সমাজ কখনোই ‘কাউন্টেবল বা এক্সাম্পল’ হতে পারে না। ইটস্ মাই পার্সোনাল ওপেনিয়ান।

আমাদের মনে রাখা উচিত, ‘অনেস্ট ইজ দ্য বেস্ট পলিসি বা সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।’ এর ওপরে কোন মন্তর নেই। এ কথার সাথে আমি ৯৯% নয়_শত ভাগ একমত। এদেশে সৎ ও নীতিবানদের জীবন ও সম্মান দিনকে দিন রীতিমতো ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যাচ্ছে। অপরদিকে পাল্লা ভারি তথা ‘পোয়াবারো’ হচ্ছে নষ্ট ও নীতিহীনদের। এটা সমাজ ও রাষ্ট্র কারো জন্যই সুখবর নয়।

আমরা সবাই এর মজা পুরোপুরি টের পাবো আরো পরে। আরে, চোরওতো চায়_তার ছেলেটা তার মতো না হয়ে, সৎ ও নীতিবান হোক।

সাংবাদিকদের ভোটে যারা নেতা নির্বাচিত হন, তাদের উচিত পেশার সংস্কার করা। এটা সাধারণ সদস্যদের দায়িত্ব নয়। নাগরিক তথা দেশের মালিকরা সংসদে এমপিদের পাঠান আইন-কানুন প্রণয়ন করতে। তারা যদি শুধু পরিবারকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন_তাহলে কমিউনিটিকে নিরাপদ করবে কে? যারা ভোটে দাড়ান_তাদের বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার বলে আমি মনে করি। সাংবাদিক নেতারা যদি বিষয়টি আমলে না নেন_তাহলে এটা দেখবে কে? এজন্যই আপনার কমিউনিটি এবং পেশার সম্মান, অবস্থান ও মর্যাদা টাইটানিকের মতো জলের অতল গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। আরো যাবে। তাই সাংবাদিক নেতাদের এ বিষয়ে এখনো সজাগ ও সতর্ক হওয়ার সময় রয়েছে বলে আমি মনে করি।

আমরা সমস্যার কম তিমিরে নেই। আমাদের ব্যধিগ্রস্ত দেহটি যখন ডাক্তারের কাছে যায়_তখন স্বজনরা ভীষণ আতংকে থাকেন। কেনো? কারণ_না জানি আমি ও আপনি ভুল বা অপচিকিৎসার শিকার হই। আপনাদের সাথে যে, ডাক্তারের সম্পর্ক ভালো নয়_পরিবার ও আত্মীয়দের সেটা অজানা নয়।

২০১৪ইং সালের ২ জুন মধ্যরাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে_ভোরের কাগজের বিনোদন প্রতিবেদক কিশোর কুমারের মৃত্যু_সে কথার সত্যতাই জানান দিয়ে গেছে। ডিআরইউ’র তৎকালিন সভাপতি শাহেদ চৌধুরীসহ অনেক সিনিয়র সহযোদ্ধাকে (কিশোরদার লাশকে সামনে নিয়ে) সেদিন ডিএমসির ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে দেখেছি।

এছাড়া ১২ জানুয়ারী’ (মঙ্গলবার) ২০২১ইং জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রথম আলোর শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক বড়ো ভাই মিজানুর রহমান খানের জানাজায় তার ভাই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মরহুমের ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলেছিলেন।

লেখক: স্থায়ী সদস্য, ডিআরইউ
(সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক ও জীবন গবেষক)
এস/এ