বিপন্ন সংস্কৃতিকর্মী, রহস্যময় নিরব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়
মিজানুর রহমান
সমাজের নানা পেশার মানুষের মধ্যে শিল্পীরা অন্যরকম ও অনন্য। বিবেকের তাড়নায় তাঁরা মানুষ,সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। নিজেকে উজার করে সৃষ্টিতে মগ্ন থাকতে পছন্দ করেন। তাদের জীবনের বড় একটি সময় বিনিয়োগ করেন প্রস্তুুতি পর্বে,তারপর পুরোপুরি সৃজনে মনোযোগী হন।
সৃজনানন্দে বুদ হয়ে থাকা মানুষ গুলো কখনো বৈষয়িক হিসেব মিলানোর চেষ্টাও করেন না। সমাজের অনেকের কাছে শিল্পীদের ক্রিয়া,জীবন ধারা তথা সৃষ্টিশীলতা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বল বিবেচিত নাও হতে পারে। যেমন মানুষ অসুস্থ হওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারেনা সুস্থতার স্বস্তি টুকু।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান ভাবনা গুলোর মধ্যে সংস্কৃতির অবাধ চর্চা ও বিকাশের বিষয়টিও মূখ্য ছিল। বাঙালি সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিক গুনাবলি ও দেশপ্রেমের ভান্ডার। জাতপাত গোষ্ঠী বিভাজনকে এই সংস্কৃতি প্রশ্রয় দেয় না। যুগে যুগে সংস্কৃতির মানুষেরা অন্যায় অত্যাচার দুর্নীতি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভুমিকা রেখেছে ।
শিল্পী সমাজ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহনের পর স্বাধীন দেশে সামরিক স্বৈরশাসক ও মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা রাখে। নাটক,গান,কবিতা,আবৃত্তি, নাচ,চিত্রাংকন,যাত্রা ও চলচ্চিত্রসহ শিল্পের সকল ধারায় সারাদেশে কয়েক লাখ সংস্কৃতিকর্মী কাজ করেন। আমাদের দেশে সংস্কৃতি চর্চা পেশা হিসেবে নেয়ার মতো অবস্হা এখনো তৈরী হয়নি।
শিল্পীদের বড় একটি অংশ অন্য পেশায় উপার্জন করে নিজের ও পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করে মনের তাগিদে আর শিল্পের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কারনে শিল্প চর্চা করেন। তবে কিছু মানুষ এখানে পরিস্থিতির শিকার হয়ে স্বল্প সম্মানিতে গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হোন। আবার টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত থেকে কেউ কেউ ভালো আছেন আর কেউ কেউ মোটামুটি চলার মতো আছেন।
তাদের সংখ্যাটা সর্বোসাকুল্যে কয়েক’শ জন হবে হয়তো।
আমাদের দেশের প্রশাসন,সরকার ও সাধারণ মানুষের কাছে শিল্পী বলতে ঐ গুটিকয়েক মানুষই দৃশ্যমান অথচ কয়েক লাখ নিবেদিত শিল্পী থাকেন দৃষ্টি সীমার বাইরে, সকলের নজর পড়ে না তাদের দিকে। দলগত চর্চার কারনে এই সকল শিল্পীরা থাকেন প্রচারের বাইরে।
সংকট কালে সরকার দায়সারা ভাবে মুখচেনা কয়েক জনকে সামান্য কিছু দিয়ে দায়মুক্ত হতে চেষ্টা করেন। এবারের সংকট মারাত্মক। কোভিড-১৯ সবকিছু তছনছ করে বিশ্ববাসীকে দিশেহারা করে দিয়েছে। করোনার আঘাতে আমাদের দেশে গুটিকয়েক ব্যবসায়ি ব্যতিত প্রায় সব মানুষই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্হ্য হয়েছে। তার মধ্যে শিল্পী সমাজ খুবই বিপদ জনক বিপন্ন অবস্থায় আছেন।
২০২০ সালের ৮ মার্চ আমাদের দেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। এর ভয়াবহতা থেকে দেশের মানুষ কে রক্ষা করতে গিয়ে সেই যে লকডাউনে পড়লো দেশ তারপর থেকে অদ্যাবদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ আছে। যারা পেশা ভিত্তিক সংস্কৃতি চর্চায় ছিলেন অথবা অন্য পেশায় থেকে সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে কাজ করতেন তাদের বড় একটি অংশ কাজ হারিয়ে বিপদে পড়েন।
কেউ কেউ পরিবার পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে অন্য পেশায় কিছু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হন।
জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন সমুহের নেতৃবৃন্দ শিল্পীদের অভিভাবকত্ব করেন।২০০৯ সাল থেকে ধারা বাহিক ভাবে ক্ষমতায় থাকা সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিল্পী সমাজ নিজেদের শেষ আশ্রয়স্হল হিসেবে বিবেচনা করে। তাই কোন ধরনের আন্দোলনে না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সুফল পাওয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু কোন এক অজানা কারনে শিল্পীরা সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। এই ধারা আরও দীর্ঘায়িত হলে রাজপথেই সমাধান খুজতে হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। নেতৃবৃন্দ নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বিপদে পড়া শিল্পীদের পাশে দাড়িয়ে দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানায়।
বাস্তবতা হলো দেশে ধনী লোকের সংখ্যা বাড়লেও উদার দানশীল,পরোপকারী মানুষের সংখ্যা কমেছে বলে মনে হয়। এটি ভোগবাদী সমাজ কাঠামোর বাস্তব রূপ মাত্র।
সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে দীর্ঘ দেনদরবার ও তদবীরের মাধ্যমে সারাদেশের সকল ধারার অতি বিপদগ্রস্ত পাঁচ হাজার সংস্কৃতিকর্মীর একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। প্রাথমিক ভাবে ২০২০ সালের জুন মাসের পুর্বেই তাদের প্রত্যোক কে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে দেয়া হয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর কোন অনুদান প্রদান করা হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বন্ধ থাকে। তবে মাঝখানে অল্প কয়েক মাসের জন্য শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিলেও সেটি শিল্পী ও দর্শকদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনার আগেই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারনে বন্ধ হয়ে যায়।
নাট্যদল গুলোর প্রযোজনার সাথে নেপথ্য কর্মী হিসেবে সেট, লাইট, মেকাপ, সাউন্ডসহ প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত মানুষদের এটিই পেশা। তারা শিল্পের অপরিহার্য মানুষ অথচ লকডাউনে তাদের আয় রোজগার একেবারেই বন্ধ হয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় অতিমারি কালে এই সকল মানুষদের মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমানে প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। আশা করে ছিলাম অন্তত বাংলা নববর্ষ ও দুই ঈদের সময় কিছুটা সহযোগিতা পাবে। সেই অপেক্ষার পর ঈদুল আজহার পুর্বে বড় আশা নিয়ে সার্বোক্ষনিক যোগাযোগ করেও শিল্পকলা একাডেমি ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েনে মন খারাপ করে শুন্য হাতে ফিরতে হয়।
গত রোজার মাসে যে টাকা ছাড় করানোর কথা সেই টাকা এখন পর্যন্ত কাদের কারনে পাওয়া যায়নি তা ক্ষতিয়ে দেখার দাবি করছি মাননীয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে। আর নতুন করে শুরু হওয়া লকডাউনের মাঝে প্রণোদনার টাকা বিপদগ্রস্ত শিল্পীদের কে বুঝিয়ে দেয়ার জোর দাবি করছি।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা,কর্মচারী, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগন যদি দায়িত্ব শীল না হন, মানবিক আচরণ করতে ব্যর্থ হন স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে দেশের সাধারণ মানুষ। সুতরাং আর বিলম্ব না করে মানুষের পাশে দাড়ান। মনে রাখবেন এই দুঃসময় সারা জীবন থাকবেনা। সুন্দর আগামী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আর এই সুন্দর আগামী আলোর দিশারি হবে এইদেশের শিল্পী সমাজ। লেখক: সভাপতি বাংলাদেশ পথ নাটক পরিষদ
এস/এ