বৃদ্ধাশ্রমের একঘরেই বাবা, ছেলের ঠাঁই

বৃদ্ধাশ্রমের একঘরেই বাবা, ছেলের ঠাঁই

—হাসান সান্তনু

চৌধুরী আজিজ আহমেদ বৃদ্ধাশ্রমে তার বাবার কক্ষে শেষবারের, বা আমৃত্যুকালের মতো আসেন রাত দশটার দিকে। পঁচাত্তর বয়স ছুঁয়ে যাওয়া বাবা আফতাব চৌধুরী এশার নামাজ পড়ে বিছানায় ছড়ানো জায়নামাজে শুয়ে তসবিহ জপছিলেন। অন্য সবকিছুর মতো তার চোখ থেকে ঘুমেরাও সরে গেছে! নিজের ছেলেকে দেখেও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, রক্তপিণ্ড থেকে জন্ম নেয়া সেই সন্তান কী না! বয়সের চাপে ঝাপসা হয়ে আসা চোখের দৃষ্টি প্রতারণা করছে কী না, নিশ্চিত হতে হাতড়ে চশমাটা নেন আফতাব। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ভীষণ রকমের আর্তনাদ করাটা সামলাতে পারেননি। এরপর যা জানলেন তিনি, ছেলের এমন নিয়তির কথা কখনোই ভাবেননি।

জীবনের শেষ দিনগুলো বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কাটালেও আর কোনো বাবা-মায়ের সামনে যেন এমন পরিণতি না আসে, এ আর্শীবাদই আফতাব করেছেন নিরন্তর। অথচ তার রক্তজ ধন, অস্তিত্বের অংশ আজিজেরই ঠাঁই হলো আশ্রমের এ কক্ষে। আফতাব কর্মজীবনে ছিলেন ডাকসাইটে সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। জামাতার সঙ্গে মেয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে; এক ছেলে বউ বাচ্চা, শাশুড়িসহ থাকেন ব্রাজিলে। বড় ছেলে আজিজই থাকেন দেশে। তারা ঢাউস মাপের বড়লোক, পয়সাওয়ালা। প্রায় দশ বছর ধরে আফতাব আছেন ঢাকার এ বৃদ্ধাশ্রমে। স্ত্রী মারা গেছেন তিনি বৃদ্ধাশ্রমে আসার আগেই। বেঁচে থাকলে বৃদ্ধা বেচারিকেও হয়তো শেষ বয়সে আধুনিক সংসার নামের তামাশার শিকার হয়ে কোনো একটা বৃদ্ধাশ্রমেই কাটাতে হতো!

চৌধুরী আজিজের বয়স মাত্র পঞ্চাশ পার হয়েছে। চলনে-বলনে সবসময় নিজেকে এলিট শ্রেণির দলে রাখতেন তিনি। হঠাৎ করে কঠিন একটা রোগ শরীরে ঝাঁকিয়ে বসে। শরীরের একটা অংশ অবশ, প্যারালাইজড হয়ে যায়; এলেবেলে হয়ে যায় চারপাশের অনেক কিছু। পাঁচ-ছয় মাস চিকিৎসা চলে দেশ-বিদেশের নামকরা হাসপাতালে। স্ত্রী, একমাত্র ছেলে তখন পাশে ছিলেন। বাকি জীবন পর্যন্ত শরীরের অর্ধেকের বেশি অবশ হয়ে যাওয়া বেঁচে থাকতে হতে পারে, চিকিৎসকরা এ তথ্য জানানোর পর থেকে তিনি ‘বোঝা’ হয়ে উঠেন। স্ত্রীও নতুন জীবন গড়তে এক বন্ধুর হাত ধরে বিদেশে চলে গেছেন। একমাত্র ছেলে ওর বউকে নিয়ে দেশ-বিদেশে সময় কাটান। ঘরে এমন ‘আধমরা বোঝা’ থাকলে আনন্দ-ফূর্তি করা যায়? তাই তারা বাবা বা শ্বশুর আজিজকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন।

আজিজ চৌধুরী স্ত্রী, ছেলেসহ তার বাবা আফতাব চৌধুরীকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসতে গিয়েছিলেন রাতের বেলা। দিনের বেলায় হলে, বা কেউ দেখে ফেললে মান-সম্মান চলে যাওয়ার ভয়ে। আজিজকে তার ছেলে, ছেলের বউ মিলে ওই বৃদ্ধাশ্রমেই রেখে আসেন এক রাতের ঘন কালো অন্ধকারে। আজিজ বৃদ্ধাশ্রমে বাবার কক্ষে আশ্রয় নেয়ার বছর খানেকের মধ্যেই তার বাবা মারা যান। এক ভোরে তিনি জেগে দেখেন- বাবার নি:শ্বাস বন্ধ। যে বুকে তিনি অপত্য আদরে খেলে, লাফালাফি করে বড় হয়েছেন, সেই বুকটা একেবারে নিথর। নিজের সন্তানকেও কাছে টেনে নেয়ার আকুতি নেই।

আফতাব চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে। উঠোনের এক কোণের সজিনা গাছটার ধারেই হয় কবর, স্ত্রীর পাশে। বাবার মরদেহের সঙ্গে গ্রামে আসা আজিজ চেয়েছিলেন, বৃদ্ধাশ্রমের বদ্ধ কক্ষটার বদলে গ্রামের খোলামেলা বাড়িতেই থেকে যেতে। তার ছেলে, ছেলের বউ রাজি হননি। জানাজানি হলে লোকেরা এ নিয়ে কানাকানি করবে, তখন সম্মানের বারোটা বাজবে! তারা জোর করেই তাকে গ্রাম থেকে এনে আবার বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর আগে আজিজের প্রয়াত বাবাও বলেছিলেন- তাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে। সেখানে রান্নাবান্নার জন্য কাউকে রাখলেই সমস্যা মিটে যাবে। বাবার এ কথায় তখন আজিজ, তার স্ত্রী রাজি হননি, সম্মান খোয়ানোর ভয়ে।

বাবার মৃত্যুর পর থেকে বৃদ্ধাশ্রমে নিজেকে আরো বেশি একা মনে হয় আজিজের। বাবার জায়নামাজটাতেই তিনি নামাজ পড়েন, বাবার তসবিটা হাতের আঙ্গুলে চেপে স্রষ্টাকে মনে করেন। এসব জিনিস বাবাকে আশ্রমে রেখে তিনিই কিনে দিয়েছিলেন। কার জন্য কেনা, অথচ ব্যবহার করেন কে! প্রকৃতি প্রায়ই উদ্ভট খেয়ালিপনায় মেতে উঠে। বাবার ব্যবহার করা চশমাটাও এখন তিনি খুব আগলে রাখেন, সিথানের কাছেই থাকে। বাবার গন্ধ খুঁজে পান ওটাতে। অথচ তিনিই একদিন বাবার ব্যবহারের পুরনো সব জিনিস নিজের ঝকঝকে বাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আজিজ কয়েকবারই ভেবেছেন, নিজের জন্মদাতাকে সেখানে ফেলে আসার অভিশাপ কী? আশ্রমের একই কক্ষে থাকাকালে তিনি বাবাকে বলেছেনও অনুতাপের স্বরে- ‘তোমার অভিশাপেই আমার এ পরিণতি। ক্ষমা করে দিও।’ বৃদ্ধ বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে আশ্বস্তও করেছেন- ‘আশ্রমের মতো কারাগারে পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানও থাকবে, এটা কোনো বাবা-মা চান না। মা-বাবা কখনোই সন্তানকে অভিশাপ দেন না।’ আজিজও চান না, তার ছেলের কোনো আগামিকালেই বৃদ্ধাশ্রমে তার কক্ষে আশ্রয় হোক। এবারের বাবা দিবসে আজিজের ছেলেও ফেসবুকে নিজের বাবাকে নিয়ে আবেগময় স্ট্যাটাস দিয়েছেন। দেশে থাকলেও বাবাকে দেখতে গত তিন মাসের মধ্যে একবারের জন্যও বৃদ্ধাশ্রমে যাননি তিনি। অবশ্য খরচের কিছু টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বি.দ্র.- উপরের ঘটনা সত্য, নামগুলো মিথ্যে। তাদের নাম, ঠিকানা দয়া করে কেউ জানাতে না বললে কৃতার্থ হবো। ফেসবুক থেকে নেওয়া।