বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি এবং সাকিব কান্ড

বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি এবং সাকিব কান্ড

মো: সামসুল ইসলাম, ক্রীড়া ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক : সাকিবই উসকে দিলেন আমাকে এই লেখাটি লিখতে। সাকিব ও আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের অনিয়ম আর নোংরামি নিয়ে চারপাশে শোরগোল ব্যাপক। তাই এই প্রসংগটি কোনভাবেই এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের।

চলমান ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে খুব সম্প্রতি আবাহনী -মোহামেডান ম্যাচে সাকিবের ক্রিকেট শিষ্টাচার বহির্ভূত অপকর্ম আমাদের সবাইকে আহত ও ব্যথিত করেছে। সর্বত্র প্রমানক হিসেবে সাকিবের এই ঔদ্ধত্তপূর্ণ ঘটনাটিই ভাইরাল হয়েছে বেশি।

ঘটনাটি বাংলাদেশের ভৌগলিক সিমা ছাড়িয়ে সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বে আমাদের দেশের, আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতির ভাবমূর্তিকে খুব দৃষ্টিকটুভাবে তুলে ধরেছে। এতে আমাদের ক্রিকেট ক্ষতিগ্রস্ত হবে বৈকি। ঘটনার দিন তিনি এতোটাই উত্তেজিত ছিলেন যে, মাঠেই দু’দুবার আম্পায়ারের সাথে অসদাচরণ করেছেন, স্টাম্প উপড়ে ফেলেছেন।

মাঠের বাইরেও কথা-কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছেন। সাকিবের মতো একজন আন্তর্জাতিক তারকা আইডল এতোটা বেপরোয়া হন কি করে? ভাবতেই অবাক লাগে। তারকার যেমন খ্যাতি আছে তেমনি আছে বিড়ম্বনাও। দুটোকে স্মার্টলি সামলাতে না পারলে, আপনি আর তারকা কেন? তাই আপনার চাল-চলন, চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা, আচার ব্যবহার, গতিবিধি মাঠ ও মাঠের বাইরেও নিয়ন্ত্রিত ও পরিপাটি হতে হবে।

যেভাবে শচীন, দ্রাবিড়রা নিজেদের প্রায় সমালোচনার উর্ধ্বে রাখতে পেরেছিলেন তাদের সমগ্র ক্যারিয়ার জুড়ে। সাকিব তার অপরাধ স্বীকার করেছেন, ভক্ত ও সংশ্লিষ্টদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। শাস্তিও পেয়েছেন – তিন ম্যাচ বহিষ্কার ও ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা। তার ক্লাব মোহামেডান তাদের অধিনায়ক সাকিবকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে গেছে। এর আগেই অবশ্য সাকিবের শাস্তি মওকুফের জন্য ক্লাব আপিল করেছে সিসিডিএম/বিসিবির কাছে।

এগুলোতো সবই আমাদের জানা। কিন্তু সাকিব কান্ডে দেশ দুভাগে বিভক্ত কেন? ক্রিকেটের শিষ্টাচার ভেঙে সাকিব গুরুতর অপরাধ করেছেন, এটি যদি আমরা স্বীকার করতে না পারি, তাহলে এর মাধ্যমেই প্রমানিত হয়যে, এতো দিনেও আমাদের ক্রিকেট/ক্রীড়া সংস্কৃতি একধাপও এগোয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় একশ্রেণির ভক্ত ও অনুরাগী সাকিবের এই কান্ডটিকে ঘরোয়া ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দূর্ণীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে দেখছেন।

এই বিষয়টি সত্য এবং তা এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। কিন্তু একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ কি আর একটি অন্যায় দিয়ে করা যায়? যেদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট এবং এর অবকাঠামো যত ভাল, সেদেশের ক্রিকেট ততো সম্মৃদ্ধ, টেকসই ও সফল। ভারত, ইংল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া এক্ষেত্রে আদর্শ উদাহরণ হতে পারে।

খুব সম্প্রতি নিউজিল্যান্ড তাদের প্রথম টেষ্ট একাদশের প্রায় অর্ধেক খেলোয়াড়কে বিশ্রাম দিয়েও ঘরের মাঠে অন্যতম শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২য় টেষ্ট জিতে নিল।

ভাবুন কেইন উইলিয়ামসন ছাড়াই এ্যাওয়ে ম্যাচ জিতছে তারা। তাহলেই বুঝুন কিউইদের পাইপলাইন কতটা সম্মৃদ্ধ! অথচ আমরা বিগত ৫০ বছরে আমাদের ক্রিকেটকে প্রত্যাশামাফিক বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারিনি। ক্রিকেটের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, আঞ্চলিক ক্রিকেট এসোসিয়েশন, এগুলো দীর্ঘদিনের দাবী ও গৃহীত সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাস্তবায়নে দীর্ঘসুত্রিতা ও অনিহা। পদ/চেয়ার আঁকড়ে ধরে, দিনের পর দিন রমরমা বানিজ্য অব্যাহত রেখেছি, আর হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দিনের পর দিন ক্লাব পলিটিক্স এর নোংরামি জিইয়ে রেখেছি।

আম্পায়ারদের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা এবং হুমকি ধামকি ও প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বাধ্য করার সেই পুরনো বৃত্ত থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারছেনা বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট।

বিসিবি সারাবছর মাঠের ক্রিকেট নিয়ে এতো বেশি ব্যস্ত যে, এর পারিপার্শ্বিক উইংগুলোকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিতে হবে তা তারা ভাবেইনি বা ভাবতে পারেননি। আম্পায়ারিং, কোচিং স্টাফ, পিচ কিউরেটর, ক্রিকেট ভাষ্যকার (বাংলা/ইংরেজি), ক্রিকেট সম্প্রচার ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক ও দরকারি উইংগুলো সবসময়ই অবহেলিত থেকে গেছে।তাইতো আমাদের এলিট প্যানেলে আজও কোন আম্পায়ার নাই, ভাষ্যকার নাই, ম্যাচ রেফারি নাই।

ক্রিকেট নিঃসন্দেহে একটি সংস্কৃতি, আর তাই একে অনেক শ্রমে ঘামে, নিষ্ঠা আর যত্নে লালন করতে হবে। প্রসংগত বলে রাখি, আমি ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সময়কালে চুটিয়ে ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলাধূলা করেছি। পাড়ার ক্রিকেট, স্থানীয় টুর্ণামেন্ট, জেলা ক্রিকেট লীগ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট, সবই খেলেছি। শেষদিকে জেলা পর্যায়ে ক’বছর আম্পায়ারিংও করেছি।

খেলোয়াড় এবং আম্পায়ার দুই জায়গা থেকেই দেখেছি, কেউ কোনদিন এলবিডব্লিউ আউটের সিদ্ধান্তটি সহজভাবে হাসিমুখে মেনে নিতে পারেননি, আমিও না। মনে হতো বল টার্ণ/সুইং করে বেরিয়ে যাবে, ইম্প্যাক্ট অফ স্টাম্পের বাইরে, হাইট প্রবলেম নয়তো বল লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ করেছে, ইত্যাদি। তখনতো আর ডিআরএস ছিলোনা। স্থানীয় ক্রিকেটে/ডমেস্টিক ক্রিকেটে তা কল্পনাও করা যায়না। আম্পায়ারদের উপর আমাদের শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ক্রিকেটের স্পিরিটের কথা প্রবলভাবে ধারণ করতাম আমরা।

আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত – বিষয়টি সর্বক্ষণ মাথায় থাকতো। ক্যাচ ফেয়ার কিনা, ক্লোজ সিচুয়েশনে বাইন্ডারি রোপ টাচ হয়েছে কিনা, তা জানতে আম্পায়ারগণ সম্পূর্ণভাবে ফিল্ডারদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল ছিলেন।

এভাবেই ক্রিকেট খেলেছি, দেখেছি এবং খেলিয়েছি। আর আজ! খেলোয়াড় আম্পায়ারদের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ নাই, ব্যক্তিত্বের সাথে, বিবেকের সাথে আপোষ করে ক্লাব কর্মকর্তাদের ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহিৃত হচ্ছেন অনেক আম্পায়ার। আপনারা স্যার, আপনাদের অসম্মান কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না।

আমরাও যেন একেকজন বিশাল ক্রিকেট বিশ্লেষক বা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। ডিআরএস রিপ্লে না দেখেই বলে দিচ্ছি যে, ঘটনার সেই দৃশ্যে মুশফিক নিশ্চিত এলবিডব্লিউ ছিল, কিন্তু আম্পায়ার দেননি। রিপ্লে না দেখে আপনিই বা এতোটা নিশ্চিত হলেন কি করে? আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের জাজমেন্ট এবিলিটি কতটুকু তাও আমরা জানি।

আন্তর্জাতিক ম্যাচে আমরা কখনোই ডিআরএস যুক্তিযুক্তভাবে ও সফলভাবে ব্যবহার করতে পারিনা। আমাদের অধিকাংশ ডিআরএস লস হয়ে যায় এবং আনসাকসেসফুল হয়। আমাদের খেলোয়াড়দের মুন্সিয়ানার লেভেল বোঝা যায় এখানেই!

পরিশেষে সবার প্রতি উদাত্ত আহবান, আসুন আমরা সাদাকে সাদা, আর কালোকে কাল বলি। “ক্রিকেট ইজ এ গেইম অব জেন্টেলমেন”- এটি বাক্যটি মনের মধ্যে লালন করি।

আর ক্রিকেটের স্পিরিটকে সমুন্নত রেখে সম্মৃদ্ধ করি আমাদের ক্রিকেট/ক্রীড়া সংস্কৃতিকে। সাদা পোশাক আর লাল বলের ক্রিকেটই যে সুন্দর- তাও ধারণ/লালন করি মনে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটকে ঘিরে যত নোংরামি আছে আসুন এক লহমায় তা ছুঁড়ে ফেলি বুড়িগঙ্গায়। ক্রিকেট সুন্দর হোক, সুন্দর হোক আমাদের আগামী দিনগুলো।

লেখক: মোঃ সামসুল ইসলাম, ক্রীড়া ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক। মুখ্য গ্রন্থাগারিক, বৈজ্ঞানিক তথ্য ইউনিট, পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাভার, ঢাকা।