শৈশব
— ডা: সেলিনা সুলতানা স্মৃতি
আমাদের পৃথিবীতে তখন মিহি দানার মত রোদ্দুর ছিল। সাদা কালো টিভিতে ছায়াছন্দ ছিল, প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারের বাংলা সিনেমার অপেক্ষা ছিল। ঝুম বৃষ্টিতে একটানা জানালার পাশে কারো জন্য প্রতীক্ষার প্রহর ছিল।
পৃথিবীর সবচাইতে টেস্টি খাবার ছিল মরিচ বাটা। শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ, লবন আর সামান্য সরিষার তেল। এই সুস্বাদু খাবার যে না খেয়েছে সে এটার স্বাদ কখনই বুঝবে না। এই খাবার খাওয়ার লোভ আমার ছেলেবেলা থেকে থুক্কু মেয়েবেলা থেকে।
নানী চুলার উপরে মোটা গরম রুটি শেকতে শেকতে শক্ত বানিয়ে ফেলত। তারপর সেটা ঝাল বাটা দিয়ে খেতাম। এই রুটি আর ঝালবাটার জন্য অভিজ্ঞতার দরকার পড়ত না আমাদের।
ঠিক যেমন দরকার পড়ত না কোন বিবেচনার। প্রায় প্রতি মাসেই কাপড় চোপড় বেধে নিয়ে আমাদের তিন বোনকে নিয়ে মা চলে যেতেন নানীবাড়ি। দশ ভাই বোনের সাথে যোগ হত আরো কতগুলো খাবারের প্লেট।
নানা অনেক ছোটবেলাতেই মারা যান। তার কোন স্মৃতি আমার মেমোরীতে নাই।
তখন মা’রা দশ ভাইবোনের আটজনই লেখাপড়া করতেন। মা আর সেজ খালাম্মার কেবল বিয়ে হয়েছিল। আমার নানীর আয়ের কোন নিদৃষ্ট উৎস ছিল না। ছোটমামা নেহাত ছোট থাকায় তিনি বাদে সবাই ছাত্র পড়াতেন।
এখনকার দিনের মত এত টিউশন ফি ছিল না। অথচ কোনদিন অভাব টের পেতাম না। একটা মুরগী রান্না করে নানী সবার পাতে মাংস তুলে দিতেন। মাংসের ঝোলটাও এত স্বাদ হত যে হাত চেটেপুটে খেতাম।
একটা ডিমের অনেক ভাগিদার ছিল। আস্ত ডিম কেমন করে চকচকে হলুদ চেহারা নিয়ে ফুলে উঠত সেটা দেখা ছিল আমাদের কাছে একটা পরম বিস্ময়।
টিনের চালা দিয়ে মাঝেমাঝে বর্ষাকালে পানি পড়ত। আমরা পরম উৎসাহ নিয়ে মেঝের পানি ছাকতাম। আর বেসুরো কন্ঠে গান গাইতাম। রাস্তার পানি ঘরে ঢুকে গেলে মাছ ধরতে বের হতাম।
কয়েকটা মাছ ভুলক্রমে পেয়েও যেতাম। লাফাতে লাফাতে নানীকে বলতাম ভেজে দিতে। নুন ঝাল মরিচ দিয়ে বহু কষ্টে চুলার ধোয়ার মধ্যে রান্না করা মাছ ভাজা অমৃত মনে হত।
যেদিন পিঠা পায়েস বানাত নানী সেদিন ঈদ উৎসব লেগে যেত। সব কয়টা নাতি নাতনী থালা নিয়ে লাইন ধরে বসে থাকতাম।
কয়েকটা আম গুলে দুধে মিশিয়ে সবাইকে নানী বাটিতে ভাগ করে দিতেন। আমের আটি খাবার জন্য লোভীর মত বসে থাকতাম।
শোবার সময় মাঝে-মাঝে পাতলা চিটচিটে বালিশ পেতাম। এত মানুষের বাড়ি এত বালিশ পাওয়া যাবে কোথায়?
আমার বিচার বিবেচনা হীন মা এত গুলো মেয়ে নিয়ে দিব্যি আরামে থাকতেন, খেতেন। নানী বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় হলে সবাই মিলে আটকাত। বলত আর কটা দিন থেকে যাও। আমরাও দিব্যি আরামে থাকতে থাকতাম।
মা গর্ভাবস্থায় হলেই তার ভাই বোনেরা একেকজন একেকবার দুধ, ডিম, হরলিকস, ফলমূল এনে খাওয়াত। সেই খাবার আমরা পেটের মধ্যে খেতে খেতে দিব্যি হৃষ্ট পুষ্ট হয়ে বেড়ে উঠতাম।
বর্তমানে সেই নানীবাড়ির স্থানে তিনটা তিনতলা বাড়ি। চাল দিয়ে আর পানি পড়ে না। উঠানের কুয়োতে এখন আর ছোটমামা রাগ করে বিভিন্ন জিনিসপত্র ফেলেনা। উঠানের মুরগীর ঘরে নানী আর হাঁস মুরগি তোলেনা সন্ধ্যাবেলা। উঠোন টা সেই কবেই চাপা পড়ে গেছে ইট পাথরের তলায়।
এখন আর বালিশের কমতি পড়েনা। লেপ কাথায় বিছানা ভরা। কিন্তু সেই শান্তির ঘুম আর আসেনা।
এখন আম দুধে, পিঠে পুলিতে আর আগের স্বাদ পাইনা। এখন এতবড় বাড়িতে সারাক্ষণ হুড়াহুড়ি লেগে থাকেনা। ঝগড়ার পর কান্না, কান্নার পর বাক্য বিনিময়, গলাগলির পর শান্তিতে ঘুমানো মুখগুলো আর দেখতে পাইনা।
গলাগলি করে জড়িয়ে থাকা ভালোবাসার মানুষগুলো একে একে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
বড় অট্টালিকার মাঝে সেই তিন রুমের গাদাগাদি করে থাকা ভালোবাসাবাসি খুঁজি। বুঝে গেছি এই জীবনে ওটাই সবচাইতে অকৃত্রিম ভালোবাসার মন্দির ছিল।
দুই মামা, সেজ খালু আর নানীর মৃত্যুর পর এই বাড়িটাকে শুধুমাত্র শ্মশানবাড়ি মনে হয়।
সবকিছুই আগের চেয়ে অনেক ভালো। কিন্তু অনেক ভালোবাসার মানুষগুলোই কেবল নিঃশব্দে চলে গেছে আমাদের জীবন থেকে।
লেখিকা-
ডা: সেলিনা সুলতানা স্মৃতি
রেসিডেন্ট
ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিন ইউনিট
বিএসএমএমইউ