অপরাজিতা
আসিফ ইকবাল
অপরাজিতার সাথে দেখা হঠাৎ।
৩১ ডিসেম্বর, থার্টি ফাস্ট নাইট। মৌজ, মাস্তিতে ভেসে যাওয়ার দিন। সন্ধ্যায় আরমান, শাহীন, মামুন ঠিক করে বিয়ার খেয়ে দিনটি উদযাপন করবে। বছরের ‘স্পেশাল ডে’ বলে কাজে নেমে পড়তে দেরী করেনি এক মিনিটও।
রাত ১১টা। নাইটিংগেল বারে ঢুকেই মাথা খারাপ। সিট খালি নেই একটিও। গিজগিজ করছে। লোকের মাথা লোকে খায়। ভীড় দেখে আরমান বলে, ‘চল বের হয়ে যাই। মতিঝিল ক্লাব পাড়া থেকে বিয়ার নিয়ে নিব।’
নাইটিংগেল থেকে বেরিয়ে পড়ে তিন বন্ধু। শীতের রাত। কুয়াশায় ঢাকা ঠান্ডা থাকলেও উত্তেজনায় ঘামছিলো ওরা। রিক্সায় ফকিরাপুল মাত্র পার হয়েছে আরমান, তখনই মোবাইলে কামালের ফোন, ‘কই তুই? আমি আর বাবু কলোনীতে তোর বাসার সামনে গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছি।’
আরমানের দুই স্কুল বন্ধু কামাল ও বাবু। ছোট থেকে এক সাথে বেড়ে উঠেছে। মারামারি করেছে এক সাথে। স্কুল পালিয়েছে একসাথে। সিনেমা দেখাও একসাথে।
ফোন পাওয়ার পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে আরমান। শাহীনকে বলে, ‘দোস্ত, কলোনীতে যেতে হবে। কামালরা আসছে। বাসার সামনে অপেক্ষা করছে।’
বলেই রিক্সা থেকে নেমে পড়ে। এরপর হেটে হেটে কলোনীতে ঢুকে পড়ে। শাহীন ও মামুনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে। তারাও হাটতে থাকতে আরমানের সঙ্গে। মিনিট ১০ হাটার পর তিনজনেই দেখে লাল রংয়ের সুভারু গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে কামাল ও বাবু।
শাহীন, মামুনকে দেখে চমকে উঠে কামালরা। আরমান বুঝতে পারে, শাহীনদের মেনে নিতে পারছে না ওর স্কুল বন্ধুরা। রাগতস্বরেই জানতে চায়, ‘’কি ব্যাপার?’
কামাল বলে, ‘গাড়ীতে ওঠ।’
বিকালেও কথা হয়েছিল বাবুর সাথে। কিন্তু তখনও কোনো প্রোগ্রামের কথা জানায়নি। তাই শাহীনদের নিয়েই পরিকল্পনা করেছিল। হঠাৎ তাদের আগমনে অবাক হয় আরমান। তারপরও দুই বন্ধু শাহীন ও মামুনকে ‘সরি’ বলে বিদায় জানিয়ে কামালের গাড়ীতে উঠে বসে। যাওয়ার আগে হাজার টাকা ধরিয়ে দেয় শাহীনদের।
গাড়ীতে ওঠার পর মগবাজার এক বাসায় যায় ওরা তিন স্কুল বন্ধু। ৬ তলা বিল্ডিংয়ের ৫ তলায় উঠে। অপরিচিত বাসা। তবে পরিছন্ন ও বেশ গোছানো। নীল রংয়ে পর্দা। তার সাথে মানিয়ে নেওয়া বিছানার চাদরও নীল। সোফার গদির কাভারও নীল। বছরের শেষ দিন আর বছরের নতুন দিন উদযাপন করতেই যেন নীলাম্বরী সাজ!
অপরিচিত বাড়ীতে ঢুকে একটু অপ্রস্তুত আরমান জানতে চায়, ‘এখানে কেন?’
হাসিমুখে কামাল বলে, ‘আজ থার্টি ফাস্ট নাইট। সারা রাত মৌজ, মাস্তি করবো।’
কামালের কথা শুনে মেজাজ খিচরে যায় আরমানের। চিৎকার করেই বলে বসে, ‘’না, আমি বিয়ার খাবো। মাস্তিতে নেই।’
বলেই বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তখনই আড়াল থেকে কে জানি বলে ওঠে, ‘ডরপুক!’
শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে ওঠে। ঘুরে তাকাতে দেখে ভেতরের দরজা খুলে নীল পর্দা সরিয়ে একটি মেয়ে ঢুকছে। কালো, লম্বা, একহারা গড়নের। লম্বা চুল। কালো রংয়ের একটি সেলোয়ার কামিজ পড়া।
মুখ ঘুরিয়ে শুধু একবার দেখে। মনে ধরে যায়। চোখ ফেরাতে পারেনি একহারা গড়নের মেয়েটির সৌন্দর্য্য দেখে। দাড়িয়ে পড়ে। ফিরে আসে কামালের কাছে। সোফায় বসে পড়ে সটান হয়ে। তখনই বাবু বলে, ‘বন্ধু, কেমন লাগলো দেখতে?’
ভালো লাগায় এতোটাই বুঁদ হয়েছিল, কোনোকিছু না ভেবেই আরমান কাপা কাপা গলায় বলে. ‘ভালোইতো!’
বাবু বলে উঠে একটু চিৎকার করে, ‘বন্ধুর আমার মনে ধরেছে।’
মাথা ঝাঁকায় আরমান, ‘’হুম’।
বাসাটি বাবুর পরিচিত। বাসার বয়স্কা ভদ্র মহিলার সঙ্গে আলাপচারিতায় পরিস্কার, এর আগে বহুবার এসেছে সে। তাই সে খুব সাবলীল। কিন্তু আরমান ঘামছিল। আধঘন্টা ধরে বসে আছে সোফায়। অথচ মনে হচ্ছিল, কতকাল। সময় যাচ্ছেনা।
মেজাজ ধীরে ধীরে যখন চরমে উঠছে, তখনই মেয়েটি এসে পাশে বসে। কানে কানে বলে, ‘মন না চাইলে এসেছেন কেন?’ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আরমান। কেমন যেন বিবশ হয়ে পড়ে তার শরীরের উষ্ণতায়। মিনিট পাঁচেক পর মুচকি হেসে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। বাধ্য ছেলের মতো সেও ঢুকে পড়ে। রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দেয় মেয়েটি। কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়ে আরমান। মেয়েটি হ্যাচকা টানে খাটে বসিয়ে বলে, ‘গল্প করবেন, না…’
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আরমান। বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম কোনো নারীর সান্নিধ্যে এসেছে। সঙ্গ পাচ্ছে। তাই উত্তেজিত।
কাপা কাপা স্বরে বলে, ‘গল্প করবো।’
হেসে গা লুটিয়ে বলে উঠে, ‘শুধুই গল্প…আর কিছু নয়? টাকা নস্ট করবেন শুধু শুধু!’
কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে দেখতে থাকে আরমান।
মেয়েটি বুঝতে পারে আরমান নার্ভাস। তাই বলে, ‘লাইট নিভিয়ে দিব?’
আরমান, ‘না।’
‘লজ্জা করবে তো।’
আসলে মাথায় তখন কিছুই কাজ করছে না আরমানের। তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি হড়হড়িয়ে বলতে থাকে, তার নাম। কি করে, কোথায়,তাকে- এসব।
আরমানের নার্ভাসনেস কাটাতে আস্তে করে আঙুল দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ে আরমানের উপর। শরীরে বিদ্যুত খেলে যায় সাথে সাথে। এরপর ঘোরলাগা কন্ঠে বলে, ‘আমি অপরাজিতা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।’
‘সত্যি?’
মাথা নাড়ায়, ‘হুম’।
এরপর নিজের পরিবার, পড়াশোনার গল্প, কিভাবে এ লাইনে এলো-সব বলে।
বলতে বলতে রাত পেরিয়ে কখন ভোরের আজান দেয়, মনে করতে পারেনি। একসময় বিছানায় উঠে বসে আরমান। শরীর তখনও ভালোলাগায় বিবশ! ৫০০ টাকার ১০টি নোট দিয়ে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়।
অপরাজিতা বিছানায় উঠে বসে। রুম থেকে বের হবে, তখন হাত ধরে অপরাজিত বলে, ‘আপনার টাকাটা পুরোপুরি জলে গেল। আমার অবশ্য লাভই হয়েছে। শরীর বিক্রী না করেও টাকা পেলাম।’
হেসে উঠে আরমান, ”আমার ফোন নম্বরটা দিলাম। যদি কোনোদিন মনে হয় ফোন দিও।’
মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘হুম’।
আরমান মুগ্ধ হয়ে ছিল অপরাজিতার কথা ও আচরণে। যথেষ্ট পড়াশোনা জানা। নার্ভাসনেস কাটাতে যেভাবে নানান গল্প শুনিয়েছে, তাতে মুগ্ধ হয়েছে। এছাড়া গুনগুনিয়ে একটি গানও শুনিয়েছে-
‘আকাশে আজ রঙয়ের খেলা,
মনে মেঘের ভেলা…’
এরপর অনেকদিন পার হয়েছে। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। প্রথম প্রথম আরমানের খুব মনে হতো অপরাজিতাকে। খুঁজতো মনে মনে। কিন্তু কিছু করার ছিল না। ফোন নম্বর নেই। ঠিকানাও জানেনা। কতদিন ভার্সিটিতে গেছে তাকে খুঁজতে। কিন্তু ব্যর্থ মনোরথে ফিরেছে। এক সময় মনে হতে থাকে, মিথ্যা বলেছে অন্য সব মেয়েদের মতো। কষ্ট হতো। তাহলে সে অপরাজিতাকে ভালোবেসে ফেলেছে?
৮-৯ মাস হবে। এক বন্ধুর সঙ্গে আরমান নীলক্ষেত গেছে তেহারি লান্চ করবে বলে। মামুর দোকানে ঢুকতে যাওয়ার সময় একটি মেয়ে বের হয় ঝটপট। হঠাৎ তার মনে হয় মেয়েটিকে বোধহয় চেনে। কিন্তু স্মরণ করতে পারছিল না, কোথায় দেখেছে। দোকান থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠছে মেয়েটি। রিক্সায় ওঠার ঠিক আগে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে তাকে। মুখে সেই ভুবনমোহিনি হাসি! আরমান বুঝে ফেলে, অপরাজিতা। ডাকতে যাবে, ঠিক তখনই ডাক পড়ে, ‘ভেতরে আয়। জায়গা পাওয়া গেছে।’
ঢুকে পড়ে। তবে কষ্ঠ পায় কাছে পেয়েও কথা বলতে না পারায়। খেয়ে দেয়ে ফিরে আসে অফিসে। মনটা কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে অপরাজিতার জন্য। বারবার মনে হচ্ছিল সেদিনের কথা। তার গান, গল্প নাড়া দিচ্ছিল বারবার। কেমন যেন বিবশ হয়ে যাচ্ছিলো। এভাবে কেটে যায় আরও ৪দিন। ২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন, ‘কেমন আছেন? চিনতে পেরেছেন? আমি অপরাজিতা।’
মিষ্টি কণ্ঠ শুনে অনেকটা সময় চুপেছিল আরমান। কোথায় যেন হারিয়েছিলো। সম্বিত ফিরতেই বলে, ‘’ভালো আছি। তুমি?’
‘ভালো আছি। কথা বলা যাবে?’
‘এতদিন পর মনে হলো?’ যেন কতদিনের চেনা।
এরপর অবাক করে বললো, ‘কাল ফ্রি আছেন? তাহলে বিকাল ৪টায় চারুকলার সামনে আসেন। আমি অপেক্ষা করবো।’ বলেই ফোন কেটে দেয়।
আরমানের তখন চান রাত।
পরের দিন অফিসের কাজ আগে ভাগে শেষ করে পৌনে ৪টায় আড়ংয়ের পাঞ্জাবি ও জিন্স পড়ে উপস্থিত হয় চারুকলার গেটে। অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কোনো খবর নেই। অপেক্ষা করতে করতে বেশ কয়েকবার ফোন করে ওই নম্বরে। সেলফোনের ওপার থেকে বারবার বলছে, ‘এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব যাচ্ছে না।’
মন খারাপ হয়ে যায়। ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফেরার পরিকল্পনা করে রওনা দেয়। তখনই দেখতে পায়, দৌড়ে একটি মেয়ে আসছে। পরনে গ্রামীণ চেকের একটি পাঞ্জাবি। কাছে এসেই বললো, ‘সরি’।
সব ভুলে যায় আরমান। ঠাণ্ডা গলায় শুধু বলে, ‘ঠিক আছে’।
এরপর দুজনে হাটতে হাটতে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ভেতরে ঢুকে পরে।
নোট- সবাই এতো সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখে। নিজেকে কেমন ব্যাক বেন্চার মনে হয়। তাই ছোট্ট একটি গল্প লিখলাম। জানিনা, বাকিটা…
এস/এ