আফগানিস্তানের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি বা দু:খজনক ঘটনা “অনাকাঙ্ক্ষিত”

আফগানিস্তানের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি বা দু:খজনক ঘটনা “অনাকাঙ্ক্ষিত”

নোমান হোসাইন

বিশ্ব এরইমধ্যে “নৌকার লোকজন” এর সাথে পরিচিত হয়েছে। যারা সংকটপূর্ণ সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জাতির লোক, তারা তাদের বাড়িঘর থেকে পালিয়ে, বহু সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দিকে যাচ্ছিল যেখানে তারা সবাই ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, একটা সময় সহিংসতার দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। এখন আফগানিস্তানের পালা। গত মাসে সেখানে রাজনৈতিক পালাবদলের পর লোকজন বিতাড়িত হচ্ছে।

স্থলবেষ্টিত দেশটিতে বড় আকারের মানবিক সংকট উন্মোচিত হচ্ছে, এমন কি হতবাক এবং বিস্মিত বিশ্ব সম্প্রদায় তালেবানদের দ্বারা দেশটির দখলের সাথে সমঝোতার জন্য লড়াই করছে। এটি উচ্চারিত হচ্ছে কারণ নতুন শাসকরা নিরাপত্তার মৌখিক আশ্বাস দেয়ার পরও তাদের বিরোধী লোকদের রাস্তা এবং বাড়িঘর থেকে খুঁজে বের করছে বা তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

এই সংকটে সমানভাবে বড় অবদানকারী দেশ পাকিস্তানের ভুমিকা যার আফগানিস্তানের সাথে সবচেয়ে বড় সীমান্ত রয়েছে, কিন্তু পালিয়ে যাওয়া আফগানদের জন্য দেশটি তার সীমান্ত উন্মুক্ত করবে না। প্রায় সম্পূর্ণ বেড়া দেয়া সীমান্তের চেক পয়েন্টগুলো এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি কেউ পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও তাদেরকে আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

নতুন শরণার্থীদের স্পষ্টভাবে জোর করে জবরদস্তি করা হচ্ছে, এমনকি এক রাতও তাদের থাকতে দেয়া হয় না এবং তাদের আফগান সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ ৫ সেপ্টেম্বর কোয়েটায় বলেছিলেন যে, এখানে কোন শরণাথী শিবির নাই এবং সেটা করারও কোন পরিকল্পনা নাই। তিনদিন পর, একই শহর থেকে ডন পত্রিকা রিপোর্ট দেয় যে, ২০০ আফগান শিশু ও পরিবার পরিজন নিয়ে স্পিন বলডাক এবং চ্যামান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করলে তাদের আবার ফেরত পাঠানো হয় এবং আফগান কর্তৃপক্ষ তাদেরকে দেশের অভ্যন্তরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, এটা “বেআইনী জোরপুর্বক গণপ্রত্যাবর্তন”। এই পদক্ষেপের মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নাই, এটা বার বার ঘটতে বাধ্য কারণ আফগানরা মরিয়া হয়ে তাদের দেশ ছাড়তে চেষ্টা করছে। আফগান-পাক সীমান্তের ওই অংশটি কাবুল দখলের অনেক আগে থেকেই তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং পারস্পরিক সুবিধার জন্য আগে থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
তালেবান সামরিক অভিযান জোরদার হওয়ার পরপরই এ বছরের মে মাসে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি পরিস্কার স্পষ্ট করেছিল।

এইচআরডাব্লিউ এর ড. ওলসজেওস্কা উল্লেখ করেছেন যে, “ বর্তমান আংশিক সীমান্ত বন্ধ দ্বিমুখী”, কারণ তালেবানরা স্পিন বলদাকে তাদের অংশের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে যাতে পাকিস্তান কিছু বিধিনিষেধ সহজ করে। আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য এবং যারা দেশ ছাড়তে ইচ্ছুক তারা যাতে তা করতে পারে সেজন্য সীমান্ত খোলা রাখা জরুরী।

কিন্তু পাকিস্তান ইচ্ছুক না এবং এর পরিকল্পনা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সেখানে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করা তিন লাখ আফগানের সাথে আর কাউকে যোগ করতে চায় না। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, বিশ্লেষক এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী আফগানিস্তানে সংঘর্ষের কারণে মানুষ ছাড়াও মাদকদ্রব্য এবং অস্ত্রশস্ত্রের চালান আসার আশঙ্কা আছে। কিন্তু আফগানিস্তানের ইরান ও মধ্য এশিয়া বরাবর সীমান্তে যতই উদ্বেগ প্রতিধ্বনিত হোক না কেন তা খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক সংকট সেখানে থেকেই যায়। পাকিস্তান প্রধান কেন্দ্র হিসেবে থেকে যায়।

ব্রিটেন ভিত্তিক ক্রাইসিস রেসপন্স জার্নাল (সিআরজে) উল্লেখ করেছে, “ সত্য হল দেশটির শরণার্থী সমস্যাটি নতুন কিংবা সাম্প্রতিক নয়”। টুকরো টুকরোভাবে কয়েক দশক ধরে আফগানদের বাস্তুচ্যুতি ঘটে আসছে। ইউএনএইচসিআর এর সংখ্যা অনুযায়ী, শুধু এই বছর ৪ লাখের বেশি আফগান তাদের ঘরবাড়ি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তালেবান গোষ্ঠী ক্ষমতা নেয়ার পর তারা পালিয়ে গেছে। সংস্থাটি যোগ করেছে, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এরইমধ্যে ২.৯ মিলিয়ন মানুষ আভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, সামগ্রিকভাবে সংখ্যাটি ৫ মিলিয়ন হবে।

১৫ আগস্ট তালেবানরা কাবুলে প্রবেশ করার সাথে সাথে দেশটির রাজধানী শহরটির ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অনেকেই ভিসাসহ আবার ভিসা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করার জন্য বিমানবন্দরে ছুটে যায়। অনেকেই ইসলামিক স্টেট-খোরাসানের নতুন ক্ষমতাগ্রহণকারীদের গোলাগুলির ও আক্রমণের শিকার হন। এই ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার পরও বিশ্ব সম্প্রদয় মনে হয় সংকট থেকে তাদের মনোযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সম্ভবত শরণার্থী কারা এবং তাদের আশংকা কি সে ব্যাপারে বিস্তারিত না দেখেই।

সিআরজে এর পাকিস্তান সংবাদদাতা লুভুত জাহিদ লিখেছেন, “যে কেউ এবং এবং প্রত্যেকেই পালিয়ে আছে বা দৌড়ের উপর আছে। যারা সামরিক বাহিনী অথবা সরকারে সক্রিয় ছিল তাদের দেশত্যাগের প্রকৃত কারণ রয়েছে। এদের সাথে আরও রয়েছেন, অ্যাক্টিভিস্ট, উদার চিন্তাবিদ এবং সাধারণ মানুষের একটা ভাল অনুপাত যারা আতংকের মধ্যে আছেন”।

“এটা শুধু তালেবানরাই নয় যাদের মানুষ ভয় পায়, এটা এমন বিশৃঙ্খলা যা এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে—যেটা আফগানিস্তানে অপরিচিত নয়। আপনি কি অপরধী, লুটতরাজকারী, ডাকাত এবং ধর্ষকদের জন্য অপেক্ষা করবেন অথবা পালিয়ে যাবেন? যারা পালিয়ে গেছেন তারা এই প্রশ্নের উত্তর তাদের পা দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন”। জাহিদ আবেগের সুরে বলেন।

লন্ডনের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবিজ্ঞানী ড. লিজা শুস্টার গ্রাউন্ড পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন। গত ১০ বছরের মধ্যে তিনি ৬ বছর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল কাটিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি ব্যাখ্যা করেন: “শিক্ষিত লোকজনই ভয় পেয়েছেন বা আতংকিত বেশি, সেইসব মানুষ যারা সুশীল সমাজে সক্রিয় ছিলেন, এবং যারা সরকারের জন্য কাজ করেছিলেন। আমি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড দেখতে পেয়েছি, লোকেরা কাগজপত্র পোড়াচ্ছে এবং এমন কোন নথি ধ্বংস করার চেষ্টা করছে যা তাদের সরকার বা নাগরিক সমাজের সাথে সংযুক্ত প্রমাণ করতে পারে এবং লোকেরা তাদের মাথা নিচু রাখার চেষ্টা করছে”। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ক্ষমা করার প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তালেবানরা মনে হয় খারাপ উদ্দেশ্যে ঘরে ঘরে যাচ্ছে। “তারা সরকারি যানবাহন এবং সরকারি নথির সন্ধান করছে এবং তারা এটি এমন এলাকায় করছে যেখানে বেশিরভাগ হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে” তিনি উল্লেখ করেন।

টিম ফক্সলি, একজন স্বাধীন রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক ২০০১ সাল থেকে দেশটি পর্যবেক্ষণ করছেন। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সুইডিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন বিশ্লেষক, তিনি দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যাপারে গভীর অন্তর্দৃষ্টি রাখেন। “কেউ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না”, তিনি বলেন।
“মানুষ দেশত্যাগ করবে সাধারণ মনুষ্য হিসাবনিকাশের ভিত্তিতে যা তাদের ভয়াবহ মুহুর্ত বা পরিস্থিতিতে করতে হয়—আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য সবচেয়ে কম বিপজ্জনক কি? সম্ভবত কয়েক সপ্তাহ অথবা কয়েক মাসের জন্য আমরা বাইরে থাকব এবং তারপর ফিরে আসব? তিনি জিজ্ঞেস করেন।

ফক্সলে জাহিদকে বলেন, “মারাত্বক এবং প্রাণঘাতী পরিস্থিতিতে সবকিছু বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, উন্মাদন তৈরি হয়, দেশে উন্নত জীবন কোথাও নেই এমন ভাবনা থেকেই মরিয়া মানুষগুলো রানওয়ের বিমানগুলি আঁকড়ে ধরে। কাবুল বিমানবন্দরটি তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে যাতে ১৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহের জন্য ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দৃশ্যগুলো এড়ানো যেত। যাইহোক, মানুষের পালিয়ে যাওয়ার মরিয়াভাব রয়ে গেছে এবং স্থল সীমানার দিকে তাদের পালিয়ে যাওয়ার এটাই ব্যাখ্যা।

যেহেতু পাকিস্তান তালেবানের সাথে বল খেলছে সেহেতু এই সমস্যা বা সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার হুমকি রয়েছে এবং এটাকে দমন করার চেষ্টা না করে কাবুল ও ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে বিষয়টির ওপর অবিরাম দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার প্রয়োজন রয়েছে।

লেখক : ভারতের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক