শিশুদের সামনে ‘ভয়াবহ বিপদ’
নিয়ন মতিয়ুল
আপনার শিশুটির চোখের ভাষা কি আপনি পড়তে পারেন? ওর চাওয়া, পাওয়া, বিরক্তি, রাগ, অভিমানের সব হিসাব কি মিলাতে পারেন? একাডেমিক শিক্ষার বাইরেও সে কি দারুণ কৌতুহলী? ওর প্রশ্নের ঝড় সামলাতে আপনাকে কি খুব নাজেহাল মনে হয়? বিব্রতকর প্রশ্নের নির্মোহ উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান? সব প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ বোধক’, হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে আপনি সৎ ও মনোযোগী একজন মা অথবা বাবা।
তাহলে আপনাকেই বলতে হবে, বিগতকালের চেয়ে, আসছে কালে আপনার শিশুর জন্য ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষমাণ। প্রচলিত মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিপদ থেকে রক্ষার প্রাণপণ লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরো সব ভয়াবহ বিপদ। যেসব বিপদের মাত্রা বাইরে থেকে আপনি আঁচও করতে পারবেন না। এখন আপনার দায়িত্ব হলো, সেসব বিপদকে বুঝতে পারার তীক্ষ্ণ উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করা।
প্রথম কথা, সন্তানদের জন্য দূষণমুক্ত, ঝুঁকি ও ভয়হীন মুক্তদেশ বা বিশ্ব গড়ার সম্মিলিত ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় বাস্তবিকই আমরা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারিনি। নিজেদের সময়ে যতটা ভোগ-উপভোগে বাঁচার চেষ্টা করছি, সন্তানদের আগামীর জন্য ততটা অবশিষ্ট রাখার চেষ্টা নেই। রাষ্ট্র বা সমাজকে বাদ দিলে ব্যক্তিগতভাবে ততটা দায়িত্ব পালন করছিও না আমরা। এই উদাসীনতাই ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রাণপ্রিয় সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীতে ঘটে চলা যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত, গণহত্যা, রক্তারক্তির মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য আমরা শুধু হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষের বীজ বপনই করে এসেছি। সামাজিক, পারিবারিক জীবনেও ব্যক্তিগত বিশ্বাস, নৈতিকতা, ধ্যান-ধারণা তাদের ওপর শুধু চাপিয়েই দিয়েছি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়করা আজ পৃথিবীতে জীবিত নেই সত্য; তবে তাদের সেই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধনীতি এখনও সক্রিয় রেখেছেন পরবর্তীকালে জন্ম নেয়া আজকের বুড়ো শিশুরা।
বিগত শতকের অর্ধেক জুড়ে শিশুর জন্য ভয়হীন মুক্ত-স্বাধীন বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে কত না অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি, হলফনামা দিয়েছি। কতটা তার বাস্তবায়ন হয়েছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ অবধি দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে যত যুদ্ধ, রাজনৈতিক সংঘাত, গণহত্যা কিংবা আন্তঃসম্প্রদায় সহিংসতায় রক্ত ঝরেছে তা দুই বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কম কীসে?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ্যসৃষ্টই হোক কিংবা প্রাকৃতিক কারণেই হোক পৃথিবীতে যত বিপর্যয় বা নৃশংসতা ঘটেছে তার বড় সাক্ষী বা শিকার হয়েছে অসহায় শিশুরা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে তার ভয়াবহ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া। সেসব নৃশংসতা আর টিকে থাকার লড়াইয়ের কৌশলের নকশা এক সময় প্রকৃতি নিজ হাতে মানব মস্তিষ্কের জিনে এঁকে দিয়েছে। যে নাকশার কারণেই আমরা কখনও কখনও সভ্যতা ভুলে হয়ে উঠি আদিম, নৃশংস, বর্বর, রক্তপিপাসু, যুদ্ধবাজ।
আর তাতে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক, অনিশ্চিত হয়ে পড়ে শিশুর জীবন, অস্তিত্ব। এমনি বিপজ্জনক এক শতাব্দী পেরিয়ে যখন আমরা একবিংশ শতকের প্রথমভাগের ঝলমলে পৃথিবীতে বাস করছি, ঠিক তখনই সভ্যতার ওপর হামলে পড়লো করোনামহামারি। সব সম্ভাবনা আর আমাদের সম্মিলিত স্বাপ্নিক উদ্যোগগুলো যেন মুহূর্তেই ভেঙে পড়তে শুরু করলো। নিরাপত্তা আর সুরক্ষার স্বার্থেই গোটা বিশ্বের শত শত কোটি শিশু যথারীতি হয়ে পড়লো ঘরবন্দী। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনিশ্চিতভাবে শাটডাউন হয়ে গেল। নতুন শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে এলো সভ্যতার ওপর।
অথচ ঘাড়ে তখনও নিঃশ্বাস ফেলছে ধীর পদক্ষেপে সভ্যতা গ্রাসে এগিয়ে আসা মহাবিপর্যয় জলবায়ু পরিবর্তন। করোনার ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যেই গেল বছরের ৫ এপ্রিল ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে এসে গেল বাংলাদেশের শিশুদের নিয়ে বড় বিপদের কথা। বলা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয় দেশের এক কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে। অবশ্য, এর আগে ইউনিসেফের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়ার অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। ভাবা যায়?
এখন আমরা যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে মহামারি থেকে সন্তানদের সুরক্ষিত রাখার কৌশল নিলাম সেখানেও দেখা গেছে বিপর্যয়। গত ২৪ আগস্ট প্রকাশিত ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন বলছে, করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম দেশ। দীর্ঘ বন্ধের ফলে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে ভয়াবহতা কিন্তু এখানেই পূর্ণবিরাম চিহ্ন দেয়নি। গেল ৬ সেপ্টেম্বর সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষাবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্বের কিছু অংশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি চললেও বিশ্বের এক–চতুর্থাংশ দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার হুমকিতে রয়েছে। এরমধ্যে ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে বাংলাদেশসহ আরও অন্তত ৪০টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক বার্তাটি দিয়েছেন সেভ দ্য চিলড্রেন যুক্তরাজ্যের প্রধান নির্বাহী গোয়েন হাইনস। তার মতে, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দরিদ্র শিশুরা, এটা যেমন সত্য, তেমনি শিশুদের শিক্ষা ও জীবনকে হুমকি বা ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার একমাত্র কারণ কিন্তু করোনা মহামারি নয়। হাইনসের মন্তব্য এটাই প্রমাণ করে, জলবায়ু পরিবর্তন আর তার থেকে সৃষ্ট দারিদ্র্যই ডেকে আনবে ভয়াবহ বিপদের বার্তা।
তবে এটাও স্বীকার করে নিতে হবে, দারিদ্র্য আর জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকির চেয়েও শিশুদের মুক্তবিশ্বের সবচেয়ে বড় বাধা আন্তঃসম্প্রদায় সহিংসতা। যে সংহিসতার পেছনে সব সময়ই মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থপরতা।
বলা যায়, রাজনৈতিক বিরোধ আর আদর্শিক দ্বন্দ্বই শিশুর জন্য প্রতিনিয়ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে তার চারপাশের পরিবেশ। ভয়-শঙ্কাহীনতার বদলে শিশুরা বেড়ে উঠছে ঘৃণা আর সংহিসতার দমবন্ধ রাজনৈতিক পরিবেশে। যার নিয়ন্ত্রণ প্রতিদিনই হাতছাড়া হচ্ছে আমাদের। আর এই দমবন্ধ পরিবেশে আমাদেরই প্রাণপ্রিয় শিশুরা যদি হয়ে ওঠে এক একজন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তাহলে কী করবো আমরা?
লেখক : সাংবাদিক