নিশিপদ্ম

—-নিশিপদ্ম

—-কৃতিকণা

রাত বাড়ার সাথে সাথে পলাশের জ্বরটাও বাড়ছে। উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে কদম। বারেবারে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে তাঁবুর বাইরে এসে আঁচল ভিজিয়ে নিয়ে গিয়ে জলপট্টি দিচ্ছে কপালে, আর কানের কাছে মুখ রেখে অস্ফুটে ডাকছে তার একমাত্র অবলম্বন, তার আট বছরের সন্তান পলাশকে।

— “পলু, অ পলু, এই ত আমি। ভয় নাই, কোনো ভয় নাই।”

ঠান্ডা ভিজে আঁচল কয়েক মুহূর্তেই গরম আগুন হয়ে উঠছে আবার। মায়ের আঁচল যেন শুষে নিতে চাইছে তার সন্তানের সব কষ্ট। কদম জানে, ভয়ে জ্বর এসেছে পলাশের। চোখের সামনে এত হানাহানি আর রক্তক্ষয় সহ্য করতে পারেনি শিশুর নরম মন।

তাঁবুর ভেতরে ঘেঁষাঘেঁষি করে অসংখ্য নানান বয়সী মহিলা আর শিশুরা সারাদিনের আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় ক্লান্ত হয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। এ তাঁবুর কিছুটা দূরে আর একটা তাঁবু, যেখানে পুরুষদের আশ্রয়। সেখানেও সবাই ঘুমিয়ে কাদা। শুধু কদমের চোখে আজ ঘুম নেই। মায়ের হাত বলছে জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। বদ্যি বাপের মেয়ে কদম, তাই জ্বরের চিকিৎসা তার জানা। অথচ এই অন্ধকার রাতে, এ ভয়ানক পরিস্থিতিতে ওষুধ কিংবা পথ্যি জোগাড় করা অসম্ভব। পাগল পাগল লাগছে কদমের। মাথার ভিতরে সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। পলাশ ছাড়া এ পৃথিবীতে তার যে আজ আর কেউ নেই। পলাশ আছে বলেই যে তার বেঁচে থাকা।

একসময় সব ছিল, সবাই ছিল। নদীর ধারে ঘর ছিল। বাবা, মা ,ভাই, বোন, খোলা উঠোন, ধানের ক্ষেত, এক্কা দোক্কা খেলা, পুতুলের বিয়ে দেওয়া, ইস্কুল, খাতা বই, একদঙ্গল সই ; আর ছিল পাশের বাড়ির বিনয়দা, পূর্ণিমার রাতে যার হাত ধরে বাড়ির সকলের চোখ এড়িয়ে চুপিচুপি পানসিতে ভেসে পড়া। অনেক দূর ভেসে যাওয়ার পর, এক পরিচিত বুড়ো বটগাছের গুঁড়িতে নোঙ্গর বেঁধে পাশাপাশি শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখত দুজনে। খুব সুন্দর বাঁশি বাজাত বিনয়, আর দেশাত্মবোধক গান গাইত। কথা বলত কম, কিন্তু মুখে হাসিটা লেগে থাকত সর্বক্ষণ। আলতো হাতে কদমের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বলত, “সত্যি কদম! তর গা দিয়া কদম্বের সুবাস বেরায়। ঠিক যানি বৃষ্টি ভিজা কদম ফুলের সুগন্ধ।” গা শিরশির করে উঠত কদমের, কান দুটোও গরম হয়ে উঠত। আর এই অনুভূতিটা পাওয়ার লোভেই বোধহয় বারবার ছুটে আসত কদম।

সারাটাদিন বিনয়ের টিকিটারও খোঁজ পাওয়া যেত না। কদম বুঝত, তার বিনয়দা আর সকলের মত না; একটু অন্যরকম, রহস্যে মোড়া। তবে কানাঘুষো শুনত, বিনয় নাকি বিপ্লবী। ‘বিপ্লবী’ কথাটার অর্থ বুঝলেও, সে বয়সে তাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে কোনোই ধারণা ছিল না কদমের। কিন্তু সে কথা সাহস করে কোনোদিন বিনয়কে জিজ্ঞাসাও করে উঠতে পারেনি।

কখনো কখনো আবার খুব বেশি রকমের গম্ভীর হয়ে থাকত বিনয়। কদমের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে বলত, “কিসুতেই আমরা আমাগো দ্যাশ ভাগ হইতে দিমু না, দেইখ্যা নেস কদম।” তারপর হাওয়ায় ওড়া চুল কদমের কপাল থেকে সযত্নে সরিয়ে দিতে দিতে বলত, “আমারে তর আন্চলে বাইনধা রাখবি কদম? নইলে হয়ত কোনদিন পুলিশেই কোমরে রশি বাইনধা লইয়া যাইব গিয়া।” অতশত বুঝত না কিশোরী কদম। শুধু তার নারী সত্ত্বা টের পেত, কোনো এক অদ্ভুত অদৃশ্য টানে তাকে ক্রমশ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে উশকোখুশকো চুলের এই বিপ্লবী যুবক। চুম্বকের মত মোক্ষম তার গভীর চোখের আকর্ষণ।

এমনই এক পূর্ণিমার রাতে, মেঘের বুকে চাঁদ মুখ লুকোতেই প্রেমের দামামা বাজিয়ে ঝমঝমিয়ে সগর্জন বৃষ্টি নামল। নোঙর করা পানসিতে কদমও সভয়ে বিনয়ের বুকের মধ্যে আশ্রয় নিল। একবিংশ বর্ষীয় সদ্য যুবক তার সমস্ত শরীর দিয়ে সে দুর্যোগের হাত থেকে আগলে রাখল তার মানসীকে, ভরিয়ে তুলল আদরে আদরে। ঠোঁট থেকে ঠোঁট তুলে ঘোর লাগা গলায় বলল, “কদম ফুলেও এত্তো মধু হয় বুঝি?”

সে রাতেই আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অভিযোগে বাড়ি থেকে পুলিশে তুলে নিয়ে গেল বিনয়কে। আর পরেরদিন সকালেই কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে কদমকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বহু ক্রোশ দূরে, তার মামার বাড়ি। সেখানে গিয়ে পনেরোদিন কাটতে না কাটতেই, পঞ্চদশী কদমের বিয়ে হয়ে গেল সদ্য বিপত্নীক পাঁচ সন্তানের পিতা কাশরোগে অর্ধমৃত শীর্ণকায় বদরাগী পঞ্চাশোর্ধ্ব রামগোপাল মিত্তিরের সাথে, যার কনিষ্ঠতম সন্তানটিও কদমের চেয়ে বয়সে সামান্য কিছু বড়। তারপর অর্ধেক বছর কাটতে না কাটতেই পরলোক যাত্রা করলেন মিত্তির মশাই। তবে যাওয়ার আগে নিজের অস্তিত্বের চিহ্ন স্বরূপ কদমের অনিন্দ্য সুন্দর বঙ্কিম বাম ভ্রুতে চিরজীবনের মত একটা গভীর ক্ষত এঁকে দিয়ে গেলেন। কারণ শারীরিক ভাবে অক্ষম মিত্তির মশাই কদমকে স্পর্শ না করা সত্ত্বেও কদমের গর্ভে পলাশের উপস্থিতি টের পেয়েছিলেন এবং নিজের মৃত্যুর আগেই কদমকে বাড়ি থেকে বিদায় করার কাজটাও পাকাপাকি ভাবে সেরে গিয়েছিলেন।

ভয়ানক রকমের পট পরিবর্তনের সাক্ষী কদম। শুধু তার জীবন নয়, চোখের সামনে দেশটাকে ভাগ হয়ে যেতে দেখল সে। স্বার্থপর ক্ষমতালোভীর দল ধর্মের ধোঁয়া তুলে টুকরো টুকরো করে ফেলল নিজেদের জন্মভূমিকে।

কদম নাকি এখন আর তার নিজের দেশে নেই, অন্যদেশে! ঘর থেকে এক পাও না বেরিয়ে কি করে যে এক দেশ থেকে অন্যদেশে চলে এল সে, সেটাই বড় বিষ্ময়ের! দাঙ্গায় বাপ-হারা, মা-হারা, প্রেম-হারা কদম আজ দেশ-হারা। ভয়ঙ্কর সামাজিক পরিস্থিতি। এতদিন যাদের আত্মীয় প্রতিবেশী বন্ধু ভেবে এসেছে, হঠাৎ তারাই ভিনধর্মী অপরিচিত শত্রু হয়ে উঠেছে!‌ এখন একটাই লক্ষ্য তাদের; ধর্মান্তর করো, নয়তো নিপাত যাও। রাতের অন্ধকারে চালানো হচ্ছে অমানুষিক অত্যাচার। পুরুষদের কচুকাটা করছে, মেয়েদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলে। গ্রামের পর গ্রাম দাউদাউ করে জ্বলছে।

মিলিটারী তত্ত্বাবধানে বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ভারতে ফেরার শেষ সুযোগ। তাই আজ রাতে বিমানবন্দরের মাঠে তাদের তাঁবুতে আশ্রয়। কিন্তু ফেরা বললেই কি ফেরা যায়? ভিটে মাটি আত্মীয়স্বজন নদী নালা ছেলেবেলা মেয়েবেলা— সব যে এখানে। এই পূর্ববঙ্গই যে তাদের জন্মস্থান! তাই সে মায়া ছাড়তে পারল না অনেকেই, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মাটি কামড়ে পড়ে রইল তারা।

কিন্তু কদমের এ মায়া করা সাজে না। তার একমাত্র ধন পলাশ, বিনয়ের ভালবাসার চিহ্ন। তাই যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে তাকে। সমাজ যতই কালি ছেটাক, কদমের কখনোই মনে হয়নি সে কোনো অন্যায় করেছে। ভালবাসা অন্যায় নয়, বরং তাকে স্বীকার না করাটা অন্যায়।

বাবা বলতেন, “জ্বর শিরে চড়তে দিবা না। স্নান করায়া দিবা।” তাই জ্বরে গা পুড়ে যাওয়া সন্তানকে বুকে চেপে তাঁ
বুর বাইরে বেরিয়ে এল কদম। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে অনেকটা। চাঁদ না থাকলেও, রাতের আকাশে একটা জমাট বাঁধা চাপা দুঃখের মত আবছা আলো থাকে। সেই আলোতে খাওয়ার জলের আঢাকা বড় জালাটা থেকে গাড়ু করে জল তুলে হুড়হুড় করে ঢালতে লাগল পলাশের মাথায়।

এমন সময় একটা অস্পষ্ট আওয়াজে মুখ তুলে তাকাতেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল কদমের। একদল লোক তলোয়ারের মত ঝকঝকে অস্ত্র দিয়ে কেটে দিচ্ছে পুরুষদের তাঁবুর দড়ি! ব্যাপারটা কদমের ঠিকমত বোধগম্য হওয়ার আগেই দেখল, ত্রিপলে চাপা পড়ে যাওয়া মানুষগুলোকে কোপাতে শুরু করেছে তারা।

ভয়ানক আর্তনাদে ভরে উঠল নিস্তব্ধ রাতের প্রকৃতি। কয়েক মুহূর্ত হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরই, জ্বরে অর্ধচেতন ছেলেকে কাঁধে ফেলে ছুট লাগালো কদম। সেই অন্ধকার রাতে কোথায় পালাবে, কিচ্ছু জানে না। শুধু জানে পলুকে বাঁচাতে হবে। পলু আটবছরের হলেও বেশ লম্বা চওড়া, বিনয়ের মত। কাঁধে নিয়ে দৌড়ানো সহজ কাজ নয়। কাঁটা ঝোপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে পা। তবুও পলুকে চেপে ধরে উদভ্রান্তের মত দৌড়তে লাগল কদম।

ততক্ষণে মহিলা তাঁবু থেকে প্রাণভয়ে হুড়মুড়িয়ে দৌড়তে শুরু করেছে সবাই। গন্তব্য কোথায়, কেউ জানে না। গুটিকয় মিলিটারী গাড়ি টহল দিচ্ছিল, তারাও নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল। সবাই অন্যকে পিছনে ফেলে আগে পালাতে চায়। আর এই ধাক্কাধাক্কিতে তাল সামলাতে না পেরে আছড়ে পড়ল কদম। মায়ের কাঁধ থেকে ছিটকে পড়ল পলু।

অন্ধকারে প্রাণভয়ে ছুটতে থাকা অতগুলো মানুষের পায়ের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে কদম পাগলের মত খুঁজতে লাগল পলুকে। অসংখ্য ছুটন্ত পা মাড়িয়ে যাচ্ছে তাকে, থেঁতলে যাচ্ছে তার হাতের আঙুল। খোঁপা খুলে ধুলোয় লুটোচ্ছে চুল, পায়ের চাপে মুঠো মুঠো উপড়ে আসছে গোড়া থেকে। কিন্তু কোনোদিকেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই। এই মুহূর্তে কোনো শারীরিক যন্ত্রণাই অনুভব করতে পারছে না কদম। সন্তান হারিয়ে ফেলার ভয়ের কাছে সব যন্ত্রণাই যে তুচ্ছ! তাই সরীসৃপের মত বুক ঘষে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বেড়াতে লাগল পলুকে। প্রতিটা মুহূর্ত অনন্তকাল মনে হচ্ছে কদমের! যেন অনন্তকাল ধরে খুঁজছে সে তার সন্তানকে।

হঠাৎ, কে যেন চুলের মুঠি ধরে এক ঝটকায় তাকে কাঁটা ঝোপের ভিতর নিয়ে গিয়ে ফেলল। এই প্রথমবার ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠতেই কদমের মুখটা সজোরে চেপে ধরল বুক পর্যন্ত দাড়ি আর পিঠ পর্যন্ত চুল ওয়ালা এক বিশালদেহী পুরুষ। একমুহূর্ত তার দিকে তাকিয়েই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কদম। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, “পলুরে তুমি বাঁচাও, আমার আট বস্সরের পলু।”

— “এই আঁধার রাতে এত্তো তাড়াতাড়ি আমারে চিনতে পারলা কদম?” বুকের ভিতর সযত্নে জড়িয়ে ধরে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল বিনয়।

— “তোমার চক্ষু দুটি যে আমি আন্ধারেও চিনি।”
— “আর আমি চিনি আমার কদম্বের সুবাস।”
— “কিন্তু আগে আমার পলুরে খুঁইজ্যা আইনা দাও তুমি। খুব জ্বর যে তার।”

ভোর হতে আর কিছু বাকি। পলু বিনয়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে, পা দুটো কদমের কোলে। গা এখন আগের চেয়ে একটু ঠাণ্ডা। বিনয় পলুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করল, “পলাশ আমার পোলা, না কদম?”

পলাশ একেবারেই বিনয়ের প্রতিচ্ছবি। তাই এ কথার আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না কদম। বরং আরও একটু গা ঘেঁষে ছোট্ট মেয়ের মত বিনয়ের একটা হাত দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসল। আনন্দে বিনয় গভীর একটা চুমু এঁকে দিল কদমের কপালে।

ভোরের প্রথম আলোয় পলুকে নিয়ে বিমানে চড়ে বসেছে কদম। ঘোষণা অনুযায়ী, স্ত্রী এবং শিশুদের আগে পাঠানো হবে, পরে পুরুষরা। বিনয়কে ছেড়ে কিছুতেই বিমানে উঠতে চাইছিল না কদম। কিন্তু বুঝিয়ে না হওয়ায়, বিনয় একপ্রকার জোর করেই বিমানে ওঠার লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ওদের। দুহাতে কদমের মুখটা তুলে ধরে সজোরে চুমু দিয়ে বলেছে, “আমার পলুরে আগে বাঁচা, আমি ঠিক পৌঁছাইয়া যামু তর কাছে, কথা দিলাম।”

বিমান ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। জানালা আঁকড়ে ধরে বিনয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কদম। বিনয়ের শরীরটা ছোট হতে হতে ক্রমশঃ অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কদমের বেয়াড়া চোখের জল আরও তাড়াতাড়ি আবছা করে দিচ্ছে তাকে। সে জল আঁচলে মুছতে মুছতে কদম বিড়বিড় করছে, “তুমি আমার নিশিপদ্ম! রাতের বেলায় প্রস্ফুটিত হও, সুগন্ধ ছড়াও, আকর্ষণ করো। আর ভোর হইলেই… ।”

—–ফেসবুক থেকে নেওয়া
এস/এ