তরুণ প্রজন্মের বঙ্গবন্ধু
——মো. মিজানুর রহমান
একজন মাটির মানুষ যিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবে বাঙালি জাতির বুকে জন্ম নিয়েছিলেন, সেই খাটি মানুষটি তার জন্মের শতবর্ষ পরেও স্বমহিমায় এ জাতির তরুণ প্রজন্মের মাঝে এক আদর্শ হয়ে বেঁচে আছেন৷ আমরা তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করি। কিন্তু বিভিন্ন সময় আমাদের দিকে একটা অন্ধকার ইতিহাস ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা তরুণরা একটা দীর্ঘ সময় সেই ছুঁড়ে দেওয়া অন্ধকারে ডুবে ছিলাম। কিন্তু দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকের মত স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মাঝে চিকচিক করে জ্বলে উঠেছে। যেমনটি আহমদ ছফা বলেছিলেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। এই সত্য যারা অস্বীকার করবে, তাদের সঙ্গে কোনরকম বিতর্ক, বাদ প্রতিবাদ করতেও আমরা রাজি হবো না। যদি কিংবা কিন্তু দিয়ে ইতিহাস হয় না। সত্যিকার ইতিহাস হলো যা ঘটেছে তার সঠিক বিবরণ। ঘটনা পবিত্র কিংবা তার ব্যাখা নানারকম হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান নাম এমন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে পরেছে, যত পন্ডিত হোন না কেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণর নিপুণতা এবং যুক্তির মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি একটা থেকে আর একটাকে পৃথক করতে পারবেন না। আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ‘শেখ মুজিব: তাকে যেমন দেখেছি’ নামে একটা বই প্রকাশ করেছিলেন। আবুল ফজল লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের তিনি শুধু নির্মাতা নন, প্রধান নায়কও। ঘটনাপ্রবাহ এবং নিয়তি তাকে বার বার এ নায়কের আসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ নিজে করেনা ছেদন। শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশে শুধু নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও। কারণ ইতিহাস অখন্ড। সুনামে-দুর্নামে, অসাধারণ সাফল্য ও শোচনীয় ব্যর্থতার জন্য ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।’ আজ আমরা জানি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অভিন্ন ইতিহাস। ইচ্ছে করলেই কখনো কেউ আলাদা করতে পারবে না। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু এক অবিস্মরণীয় নাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর আজীবন লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট আর কারাভোগের ফলেই আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন দেশ। তিনি ছোট বড় সকলের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব, চিরস্মরণীয় এবং বরণীয়। ১৯৫০ সালে ফরিদপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব একটা পত্র লিখলেন সোহরাওয়ার্দী বরাবর, ‘আমাকে ফরিদপুর জেল থেকে গোপালগঞ্জ হাজিরা দিতে হয়। যেতে সময় লাগে ৬০ ঘন্টা। আর গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গিপাড়া যেতে হয় হেঁটে ৫ ঘন্টা, আর নৌকায় আরো বেশি সময় লাগে।’ টুঙ্গিপাড়া তখন অজপাড়া গাঁ। রাস্তাঘাট নেই, শুধু জলের মতো ছড়ানো খালের মাঝে একটা নদী, নাম মধুমতি। কাটাগাঙ দিয়ে স্টিমার চলতো। স্টিমার করেই খুলনা এবং সেখান থেকে কলকাতা। স্টিমারেই তিনি যেতেন ঢাকা৷ ১৯২০ সালে এই গ্রামেই ঢেউটিনের চৌচালা ঘরে ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।মুনতাসীর মামুন ‘বাঙালির মন ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ শিরোনামে লিখেছেন,”বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত ২০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা প্রকাশ করেছে। গত বিশ দিনের কাউন্টডাউনে প্রথমে মানুষজন তেমন আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু সপ্তাহখানেক যেতে না যেতে খবরের কাগজের পাঠক ও বিবিসি শ্রোতারা আগ্রহী হয়ে উঠে। দশ নম্বর পেরুতেই এরপর কার নাম আসবে সে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। নববর্ষের একদিন আগে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই নাম্বারে আছেন। তখন আর কারো মনে সন্দেহ থাকেনি যে, বাঙ্গালির প্রিয় উৎসব, পহেলা বৈশাখে, নববর্ষের দিন প্রচারিত হবে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ বা রাজনীতির কবি, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এবং তাই হলো বুধবার।’
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালির শ্রেষ্ঠতম নেতা৷ বাঙ্গালির সম্মিলিত চেতনা সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা৷ গণতান্ত্রিক, মূল্যচেতনা, শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধুর মূল কথা।এই মূলমন্ত্রকে তিনি সঞ্চারিত করেছেন বাঙালির চেতনায়। এভাবেই, ইতিহাসের অনিবার্য দাবিতে, তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন বাঙালি ও এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা ও সাহসের পাশাপাশি একটা হৃদয়ও ছিল। তিনি ভালোবাসতে জানতেন। বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন৷ তিনি বলতেন,’ সাত কোটি মানুষের ভালোবাসার কাঙাল আমি, আমি সব হারাতে পারি, বাঙালির ভালোবাসা হারাতে পারিনা।’ সাধারণ বাঙালির সব বৈশিষ্ট্যই তিনি ধারণ করেছিলেন কিন্তু অসাধারণ ছিল মানুষ ও দেশের প্রতি ভালোবাসা। তিনি বলতেন,’ আমার শক্তি এই যে, আমি মানুষকে ভালোবাসি। আসার দুর্বলতা এই যে, আমি তাদের খুব ভালোবাসি।’ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচায়, আমার দেখা নয়া চীন বইগুলো থেকে আমরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে পারি। “বন্ধুবান্ধবরা বলে,’তোমার জীবনি লেখো। সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক ঘটনাগুলো লিখে রাখো, কাজে লাগবে। আমার সহধর্মিণী একদির জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবন কাহিনি। – বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬-১৯৬৯ সালে কারাবন্দী অবস্থায় নিজের জীবনের ঘটনা চারটি খাতায় লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই লেখাগুলি নিয়েই প্রকাশিত হয় ‘অসমাপ্ত আত্বজীবনী’। কারাগারের রোজনামচা বঙ্গবন্ধুর আরেকটি দূরদর্শী লেখা। বঙ্গবন্ধু লিখেন,’বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করলো। আমরা সাধারণত মীর জাফর আলি খাঁর কথাই বলে থাকি। কিন্তু এর পূর্বেও ১৫৭৬ সালে বাংলার স্বাধীন রাজা ছিল দাউদ কারানী। দাউদ কারানীর উজির শ্রীহরি বিক্রম-আদিত্য এবং সেনাপতি কাদলু লোহানী বেঈমানি করে মোগলদের দলে যোগদান করে। রাজমাবাদের যুদ্ধে দাউদ কারানীকে পরাজিত, বন্দি ও হত্যা করে বাংলাদেশ মোগলদের হাতে তুলে দেয়। এরপরেও বহু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই বাঙালি জাত। একে অন্যের সাথে গোলমাল করে বিদেশি প্রভুকে ডেকে এনেছে লোভের বশবর্তী হয়ে। মীররজাফর আনল ইংরেজকে, সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করলো বিশ্বাসঘাতকতা করে। ইংরেজের বিরুদ্ধে এই বাঙালিরাই প্রথম জীবন দিয়ে সংগ্রাম শুরু করে; সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয় ব্যারাকপুর থেকে। আবার বাংলাদেশে লোকের অভাব হয় না ইংরেজকে সাহায্য করবার। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এই মাটির ছেলেদের ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসি দিয়েছে এদেশের লোকেরাই- সামান্য টাকা বা প্রমোশনের জন্য। পাকিস্তান হওয়ার পরেও দালালি করার লোকের অভাব হল না- যারা সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দিচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার স্বার্থরক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয় নাই। এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এতো উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কিনা!’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১১১-১১২)
১৯৫২ সালের ২-১২ই অক্টোবরে গণচীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয় যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের ডেলিগেটরাও অংশ নেন। সেই সম্মেলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও অংশগ্রহণ করেন। আমার দেখা নয়া চীন শেখ মুজিবুর রহমানের গণচীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা একটি ডায়েরির পুস্তকি রূপ।
বঙ্গবন্ধু লিখেন,’আমার একটা অভ্যাস আছে। নিজের দাড়ি নিজেই শেভ করি। কোনোদিন সেলুন বা কোথাও শেভ করি না। আমার যে ব্লেড ছিল তাহা হঠাৎ ফুরিয়ে গেল। আমি বাজারে গেলাম ব্লেড কিনতে। সমস্ত দোকান খুঁজলাম, ব্লেড পেলাম না। এক দোকানে তিন চার বৎসরের একটা পুরানো ব্লেড বের করলো তার উপরে জং পড়ে গেছে। দাড়ি তো দূরের কথা ‘চাড়িও’ (নখ) কাটবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই সমস্ত পিকিং শহরে একটা ব্লেড পেলাম না, কারণ কী? দোকানদার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি জানে। আমাকে বললো, বিদেশ থেকে এই সমস্ত জিনিস আমরা আনি না। আমাদের নিজেদের ঘরে যে ক্ষুর তৈরি হয় তা দিয়েই শেভ করি। যে পর্যন্ত আমরা ব্লেড ফ্যাক্টরি করে নিজেরা তৈয়ার করতে না পারবো, সে পর্যন্ত ব্লেড কেউই ব্যবহার করবো না। আমরা বিদেশকে কেন টাকা দিবো?’ (আমার দেখা নয়া চীন, পৃষ্ঠা: ৫১ ‘সরকার ডাক দিলো- একশত মাইল একটা রাস্তা করতে হবে। তোমাদের যথেষ্ট অসুবিধা হইতেছে; সরকারের অত টাকা নাই, তাই তোমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করা উচিত। প্রত্যেকের আসতে হবে, অন্তত দু’দিন কাজ করে দিতে হবে। সমস্ত লোক এসে কাজ শুরু করল, সরকার তাদের খাবার দিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক মাসের ভেতর সমস্ত রাস্তা করে দিল। এইভাবে নয়াচীনে হাজার হাজার গঠনমূলক কাজ জনসাধারণ করেছে, কারণ জনসাধারণের আস্থা আছে সরকারের ওপরে এবং মনে করে একাজ তাদের নিজেদের।’ (আমার দেখা নয়াচীন,পৃষ্ঠা: ৯১) ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন বাঙ্গালীর অধিকার রক্ষায় ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তারই নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। শেখ মুজিবের তীব্র রাজনৈতিক দূরদর্শীতা ও এদেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবসা থেকেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। মূলত ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী। ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্ধী ঐ স্কুলে পরিদর্শনে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান একদল ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের কাছে যান এবং স্কুলের ছাদ সংস্কারের জন্য আবেদন জানান। সে সময় উপস্থিত সবাই শেখ মুজিবের সাহসিকতা থেকে বিস্মিত হন এবং প্রশংসা করেন। সময়ের সাথে সাথে শেখ মুজিব রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারতের মুসলিম ফেডারেশন এবং ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে হোসেন সোহরাওয়ার্ধীর সান্নিধ্যে আসেন এবং বঙ্গীয় মুসলীম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ার এক ছাত্র সম্মেলনে শেখ মুজিবকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মনোনীত করা হয়।
পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বর্তমান ছাত্রলীগ গঠন করেন। মূলত এই সময় বিশেষ করে তিনি বাঙ্গালীর দারিদ্র্য, বেকারত্ব দূরীকরণ ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দিকে ঝুকে পড়েন। ভাষা আন্দোলনেও শেখ মুজিবের ছিল বিশেষ অবদান। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজীমুদ্দীন গণ পরিষদের এক অধিবেশনে ঘোষণা দেন যে “উর্দুই হবে পাকিস্কানের রাষ্ট্র ভাষা।” প্রতিবাদি শেখ মুজিব এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২ মার্চ ঢাবির ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে তিনি একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ঐ বৈঠক থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।১১ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট পালনের সময় শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল থেকে বের হয়ে তিনি ১৯ মার্চ ঢাবির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধীকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। এতে ১১ সেপ্টেম্বর তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। ২১ জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে তিনি মুক্তি পেলেও ১৯৫০ সালে ঢাকায় দুর্ভিক্ষ বিরোধী এক মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার কারনে আবার গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশের গুলি বর্ষণের তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন জেল বসে। এসময় তিনি পায় ১৩ দিন অনশন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন এবং যুক্তফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে তার দল জয়ী হয়।১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দিয়ে শেখ মুজিবকে জেলে প্রেরণ করেন। সেসময় ১৯৬১ সালে উচ্চ আদালতে এক রিটের মাধ্যমে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।
এরপর ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব লাহোরে বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা “আমাদের বাচার দাবি” শিরোনামে পেশ করেন। মূলত ছয় দফার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতির মুক্তি তথা স্বাধীনতার এর গুরুত্ব ও পটভূমি তুলে ধরেন যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হলে ১৯৬৯ সালে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে লাখ বাঙ্গালি। যার ফলে বঙ্গবন্ধু দেখা বাঙ্গালীর স্বাধীনতার স্বপ্ন আরো দৃঢ় হতে থাকে। ১৯৬৯ সালে ৫ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে এক জনসভার বঙ্গবন্ধু বলেন “একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে বাংলা শব্দটা মুছে ফেলার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। বাংলা শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুজে পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি যে এখন থেকে এই দেশকে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ ডাকা হবে।“ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রামএবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বাঙ্গালী জাতি এ ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালো রাতে অপারেশন সার্চ লাইট এর নামে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা বাঙ্গালীর উপর গণহত্যা চালালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা বাংলার মানুষ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ের আমরা অর্জন করি এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র “বাংলাদেশ”।
মূলত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় নেতৃত্ব ও এদেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই একটি শোষিত নিপীড়িত বাঙ্গালী জাতিকে দিয়েছিল স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন খাদ্যশস্যে সম্পূর্ণ, অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলার। আমাদের তরুন প্রজন্মের উচিৎ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারন করে দেশের কল্যানে নিবেদিত হয়ে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা।
লেখক পরিচিতি: মোঃ মিজানুর রহমান